logo

রবীন্দ্রনাথ যদি না থাকতেন, তা হলে কী হতো!

  • August 16th, 2022
Arts and Literature

রবীন্দ্রনাথ যদি না থাকতেন, তা হলে কী হতো!

তুমি আমার সাত সাতটি ঋতু, তুমি আমার ২৫শে বৈশাখ

সুব্রতা ঘোষ রায়

তখন কত হবে...ছয় কি সাত বছর বয়স আমার। পাড়ার স্কুলে টু কি থ্রি, এসে গেল ১লা বৈশাখ । স্কুলের বন্ধুরা নববর্ষের ছোট্ট ফুলপাতা আঁকা কার্ড দিল একে অপরকে, ভালোবেসে । বিকেলে আমাদের শিলিগুড়ির রেল কলোনির কোয়ার্টার্সে খেলতে এল কাবেরী। ওর ছোটবোনকে নিয়ে। আমরা পুতুল খেললাম, চলে যাবার সময় কাবেরী ওর ফ্রকের পকেট থেকে বের করে দিয়ে গেল একটি কার্ড । তাতে লেখা ছিল:

প্রিয় বন্ধু সুব্রতা

‘এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ 
মরণে তাহাই তুমি করে গেলে দান’

ইতি 

তোমার বন্ধু কাবেরী

১লা বৈশাখ

কাবেরী  না বুঝেই লিখেছিল, কিন্তু আমি বয়স অনুপাতে কিছুটা বেশিই পরিপক্ক থাকায় ওর আবেগটা অনুভব করেছিলাম। পংক্তি দুটোর মধ্যে যে বেদনা, তা ছুঁয়ে গেছিল সেই ছোট্ট আমাকেও। দিদিদের দেখাতেই তারা তো হিহি করে একচোট হেসে নিয়ে মাকে কার্ডটা দেখাল। মা আমাকে কাছে টেনে মৃদু হেসে কপালে চুমু খেল, মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। আমি অপ্রস্তুত হয়ে মায়ের কোলে মুখ ডুবিয়ে বসে রইলাম। 

খানিক বড় হয়ে ভেবেছি কী সাংঘাতিক মানুষ এই রবীন্দ্রনাথ! ওঁর লেখা লাইন জায়গায়-বেজায়গায় কী অবলীলায় ব্যবহার করে দিতে পারে ক্লাস থ্রির বালিকাও। রবীন্দ্রনাথ না থাকলে কাবেরী কি নববর্ষের শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে মেরে ফেলত আমাকে? ওই বয়সে কাবেরী সেই যে আমাকে মেরে ফেলল, আমিও সেই মৃত্যুভার যেন অবচেতনে বহন করেই চলেছি। আজও।

বয়স অনুপাতে পরিপক্ক হবার কথা বলছিলাম না? আসলে আমার থেকে আমার দাদা-দিদিরা বেশ কিছুটা বড় হওয়ায় ওদের সঙ্গে মিশে মনে মনে আমিও প্রায় ওদের সমান সমান হয়ে গেছিলাম । আমাকে তিন বছর বয়সে পাড়ার ২৫শে বৈশাখের কৃষ্ণচূড়া দিয়ে মঞ্চ সাজানো অনুষ্ঠানে মাইকের সামনে তুলে দেওয়া হয়েছিল, কারণ- সেই বয়সে আমি রবীন্দ্রনাথের ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ মুখস্থ করে ফেলবার অপরাধটি করে ফেলেছি। অতএব ছোটখাটো মঞ্চ যদি একবার বাড়ির পাশে হয়েই থাকে, তবে সামাজিক উদ্যোগে তা পাড়াপড়শিকে শোনানো অবশ্য-কর্তব্য। তখন পাড়াপড়শিরা ছিল যেন একেবারে এক ও অভিন্ন পরিবার। যথাসময়ে ফাংশনে আমার নাম ঘোষণা হল, পাড়ার উত্তমদা কোলে করে নিয়ে গিয়ে মঞ্চে মাইকের সামনে দাঁড় করিয়ে দিল আমাকে।  আমি মাইক ধরে বলা শুরু করলাম। মাইকের স্ট্যান্ড কিছুটা ঢিলে থাকায় তা আস্তে আস্তে নামতে থাকলো… আমিও নিজেকে নামাতে থাকলাম, আর কবিতা বলা চলতে থাকলো…‘লহরীর পর লহরী তুলিয়া আঘাতের পর আঘাত কর...’ বলতে বলতে তুমুল হাততালি! 

উপস্থিত গেঁড়েগুগলিরা ভেবেছে কবিতা শেষ, কারণ মাইক ততক্ষণে এই লেভেলে নেমে গেছে যে আমাকে বসে পড়তে হবে । আমি তো জানি কবিতা আরও আছে, আমি সবে প্যারা শেষের জন্য একটু পজ দিয়েছি, হাততালি থামতে থামতে আমি বসে নিজেকে মাইকে অ্যাডজাস্ট করে আবার শুরু করেছি  ‘মাতিয়া যখন উঠেছে পরাণ, কিসের আঘাত, কিসের পাষাণ, উথলি যখন উঠেছে বাসনা, জগতে তখন কিসের ডর?...’ । তারপর বসে বসেই ওই করুণাধারা ঢেলে টেলে ‘ওরে আজ কী গান গেয়েছে পাখি এসেছে রবির কর’ পর্যন্ত বলে বসা অবস্থান থেকে দাঁড়িয়ে আরও একপ্রস্থ হাততালি শুনতে শুনতে নেমে যে এলাম, তারপর থেকে ভয়ডরের অনুভূতিটাই যেন জীবন থেকে গায়েব হয়ে গেল । তবে এই মধ্যবয়সে সে সব দিনের পরিচিত মানুষজনের সঙ্গে দেখা হলে তাঁরা সেই দাঁড়ানো থেকে বসে পড়ে কবিতা বলার স্মৃতি উস্কে দেন, আর ভয়ডরের বালাই না থাকলে কী হবে, যারপরনাই লজ্জিত হয়ে পড়ি আমি। রবীন্দ্রনাথ না থাকলে এই পরিস্থিতিতে আমাকে পড়তে হতো  কি?

লজ্জা বটে, কিন্তু সঙ্কোচ নয়। ততদিনে জেনে গিয়েছি যে সঙ্কোচ করে কোনও লাভ নেই, কারণ ‘সঙ্কোচের বিহ্বলতা নিজেরে অপমান’। আমিও চলেছি, রবীন্দ্রনাথও চলেছেন আমার সঙ্গে। আকাশবাণী শিলিগুড়ির যুববাণীতে অডিশন পাশ করবার পর স্টেশন অধিকর্তা আমাকে রবীন্দ্রনাথের কবিতাই পড়তে বলতেন। আমি একবার সঙ্কোচ কাটিয়ে বলেছিলাম – আমি প্রেমেন্দ্র মিত্রের কবিতা পড়ি? কিন্তু তাতে ছাড়পত্র পাইনি। ফলে রবীন্দ্রনাথ না থাকলে আমার আকাশবাণীতে কবিতা বলার যৎকিঞ্চিৎ যে অভিজ্ঞতা, তাও হয়তো হতো না।

এরপর আমার কলকাতা পর্ব। কলেজে ভর্তি, রামকৃষ্ণ মিশন-গোলপার্কের লাইব্রেরিতে কার্ড করা। এবং সেখানে আমার সিলেবাসের বই না-পাওয়া ও সেই অজুহাতেই মনের আনন্দে রবীন্দ্র-বিষয়ক নানা বই আমার হাতের কাছে চলে আসা, মনের তাগিদে অকারণেই সেই সব বই থেকে নোট নেওয়া, কলেজের রেজাল্ট বেশ বাজে করা…ইত্যাদি চলমান পরিস্থিতি সামলাতে সামলাতে আমি বুঝতে পারলাম যে আমি হয়তো একজনের প্রেমে পড়ার সব্বোনাশটি করে ফেলেছি। এবং সেও। আর সে এমনই এক মানুষ যার সঙ্গে প্রেমে আমার বিস্তর সামাজিক বাধা। কারণ সে আমার নাতিদূরবর্তী আত্মীয়। আমাদের দুই বাড়ির মধ্যে প্রবল সুসম্পর্ক, আমার মা ও তাঁর মা প্রাণের বন্ধু, কিন্তু আমাদের এই রসায়ন তাঁরা বিগলিত হয়ে মেনে নেবেন না, এটাও ঠিক। 

ফলে কিংকর্তব্যম? আবার সেই রবীন্দ্রনাথ। সঞ্চয়িতার পৃষ্ঠায় রবীন্দ্রনাথের ছবি ছুঁয়ে দু’জন শপথ করলাম…মন শক্ত করতে হবে, যে সম্পর্কের কোনও পরিণতি নেই, তাকে বাড়িয়ে কী লাভ! রবীন্দ্রনাথ না থাকলে আমরা কাকে ছুঁয়ে শপথ করতাম জানি না । তবে এই পর্বে রবীন্দ্রনাথ ফেল। আমাদের শপথ রাখতে তিনি কোনও জোরালো ভূমিকা পালন করেননি। আমার কাছে সেই সময়ে তরুণ রবির একটি ছবি ছিল, আমি মনে মনে সেই ছবির সঙ্গে কথা বলতাম, কোনওদিন মনে হতো রবি-ছবির চুলগুলো বেশ ফুরফুরে লাগছে, আমি ভাবতাম আজ বুঝি রবিবাবু শ্যাম্পু করেছেন, আবার কোনওদিন গম্ভীর, কোনওদিন ছবিটা উদাস…আমার জ্বর হলে মনে হতো রবিবাবুরও জ্বর হয়নি তো? রবিছবির এই মেঘবৃষ্টি পাগলামি পর্ব ও অদৃশ্য প্রশ্রয় দশ বছর চলার পর আমাদের আইন মোতাবেক বিয়ে হল, রবি ঠাকুর আমাদের সঙ্গে ফিল্ডে না থাকলে হয়তো উইকেট কবেই পড়ে যেত।

আপাত গৃহবিলাসী মানুষ আমরা, উঠল বাই তো ঘুরতে যাই ব্যাপারটা আমাদের মধ্যে খুব একটা নেই । তবে প্রথম শান্তিনিকেতনে গিয়ে কালোবাড়ি দেখে মনে হয়েছিল – এ তো আমার খুব চেনা জায়গা, সে এক কেমন জাতিস্বর জাতিস্বর ফিলিং, যা আমি পরে গিয়ে আর অনুভব করিনি। আর শিলংয়ে গিয়েও তাই। শিলং দেখব কী? মন যেন নতুন করে ভারাক্রান্ত হয়ে গেল অমিত-লাবণ্যর বিচ্ছেদ মনে পড়ে । ‘শেষের কবিতা’ বিচ্ছেদের না মিলনের না জীবনের নানা রঙের রচনা তা আমি এখনও বুঝি না। আপাত বিচ্ছেদ মানসিক মিলনের পথকে আরও কি পোক্ত করে? লাবণ্য অমিতকে তাঁর দেওয়া আংটি ফেরত দিয়েছিল ভালোবেসে । কেতকী অমিতকে তাঁর দেওয়া আংটি ফেরত দিয়েছিল বিশ্বাসে আঘাত পেয়ে । সৃষ্টিকর্তার আদরে তৈরি কেতকীর মূর্তি অমিতের অনাদরে যে বদলে গিয়েছে অমিত লাবণ্যের কাছেই তা উপলব্ধি করেছিল। ‘যে একদিন সম্পূর্ণ তোমার হাতে নিজেকে উৎসর্গ করেছিল, তাকে তুমি আপনার ক’রে রাখলে না কেন?’ – লাবণ্যর এই কথা অমিতকে আত্মানুসন্ধানে উদ্বুদ্ধ করেছিল। ‘অন্তত হপ্তাখানেকের জন্য তোমার দলকে নিয়ে তুমি চেরাপুঞ্জিতে বেড়িয়ে এস। ওকে আনন্দ দিতে নাও যদি পারো ওকে আমোদ দিতে পারবে’। অমিত লাবণ্যের এই প্রস্তাব রেখেছিল । প্রকৃতি ও মনের এই নিবিড় যোগ বুঝতে আমরাও শিলং থেকে গিয়েছিলাম চেরাপুঞ্জি। এ যেন সেই রবিবাবুর নির্দেশ!  না থাকলে কী হতো?

নিয়মনিষ্ঠায় পুজোআর্চা আমাদের বাড়িতে না হলেও সরস্বতী ঠাকুর এনে আলপনা দিয়ে ‘আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে…’ গেয়ে যখন আমরা সরস্বতী পুজো করি, আমাদের সঙ্গে গলা মেলায় বাড়িতে ঘরোয়া কাজের সহায়িকা নার্গিস বেগম। ওর অদ্ভুত প্রশান্ত মুখে আমি যেন আরেক সরস্বতী দেখতে পাই। রবীন্দ্রনাথ না থাকলে কে লিখতেন এই গান? রবীন্দ্রনাথ না থাকলে সময়ে অসময়ে আমরা আশ্রয় নিতাম কোথায়? কিংবা আমার মতো মানুষ কী ক’রে কখনও ২৫শে বৈশাখের উদযাপনে লিখে ফেলত… 

তোমার সঙ্গে চোখে চোখে কথা,
তোমার সঙ্গে চোখে চোখে আড়ি…
তুমি আমার প্রথম গোপন প্রেম,
তুমি আমার প্রথম বাড়াবাড়ি!
তুমি আমার প্রথম মাইক্রোফোন,
তুমি আমার প্রথম কবিতা বলা-
তুমি আমার প্রথম অডিশন… 
গদ্যেপদ্যে তোমার সঙ্গে চলা,
তোমার কাছে ভেঙে পড়ার স্মৃতি…
তোমার কাছেই প্রথম সমর্পণ,
তোমায় নিয়েই আবার উঠতে চাওয়া-
তোমার কাছেই আত্মদংশন।
তুমিই আমার প্রথম ছবির মালা… 
তুমি আমার আগুন, হৃদয় খাঁক!
তুমিই আমার ছয় ছয়টি ঋতু,
তুমিই আমার ২৫ শে বৈশাখ…

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *