logo

পাগল যে তুই…

  • August 13th, 2022
News

পাগল যে তুই…

পাগল যে তুই…

সুমন চট্টোপাধ্যায়

‘পাগল যে তুই কণ্ঠভরে জানিয়ে দে তাই জানিয়ে দে, জানিয়ে দে সাহস করে’— রবীন্দ্রনাথ
ছেলেবেলায় দক্ষিণ কলকাতার যে রাস্তায় আমরা থাকতাম সেখানে ওঁর সঙ্গে দেখা হত রোজ৷ শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা শরীরে কোনও জামা নেই, খালি পা, লজ্জা নিবারণের জন্য একটা ঢলঢলে খাকি প্যান্ট, তাও আবার নারকোলের দড়ি দিয়ে বাঁধা৷ শৈশবেই মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে, সারাটা দিন এই ভাবেই তাঁর কেটে যেত রাস্তায়-রাস্তায়৷ কথা বলতেন না কারও সঙ্গে, কেবল ডাগর চোখ-দু’টি মেলে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতেন৷ পাড়ার অবোধ বাচ্চারা ‘পাগল পাগল’ বলে তাঁকে উত্ত্যক্ত করত, হঠাৎ হামলে পড়ে প্যান্টটা নামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করত, সহৃদয় কোনও দোকানি হয়তো কোনও কোনও দিন কিছু খেতে দিতেন, কোনও পথচারী হয়ত বা চার-আনা-আট-আনা গুঁজেও দিতেন তাঁর হাতে৷ কিন্তু পয়সার প্রয়োজনটা কোথায়, কেন, কী ভাবেই বা তা খরচ করতে হয় সেটাই তো তিনি জানতেন না৷ ফলে সুযোগ বুঝে বখাটে ছেলে-ছোকরারা তাঁর উপার্জনটুকুও কেড়ে নিত৷

কয়েক বছর আগের এক অভিজ্ঞতার কথা বলছি, আইসিসিআর প্রেক্ষাগৃহে গিয়েছিলাম। ‘ঈশ্বর সঙ্কল্প’ নামের এক প্রতিষ্ঠানের অনুষ্ঠানে। তখন মনে হয়েছিল, ইশ্ আমার ছেলেবেলায় যদি ঈশ্বর সঙ্কল্প থাকত!

সেদিন স্মৃতিমেদুর ভাবনাটা চনমনে হয়ে উঠেছিল কোয়েল মল্লিক আর অগ্নিমিত্রা পালের কথা শোনার পরে৷

অভিনেত্রী কোয়েল মল্লিকের অভিজ্ঞতাটি এ রকম, বছর কয়েক আগে একদিন সকালে কোয়েলের চোখে পড়ে তাঁদের বাড়ির সামনের রোয়াকে বেশ কয়েক দিন ধরে একটি যুবা বসে থাকে, পাথরের মূর্তির মতো, হাসে না, কাঁদে না, কোনও প্রশ্নের জবাবও দেয় না৷ সাইকোলজির ছাত্রী কোয়েলের বুঝতে অসুবিধে হয় না যুবাটি ভয়ঙ্কর স্কিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত৷ খেতে দিলে খায়, কম্বল দিলে গা মুড়িও দেয়। কিন্তু সম্পূর্ণ বাক্‌শক্তিরহিত৷ কী করণীয় বুঝতে না পেরে তিনি পরিচিত এক পুলিশ অফিসারকে ফোন করেন, সেই অফিসার ঈশ্বর সঙ্কল্পের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেন, সেখানেই ছেলেটির গতি হয়৷ চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে ওঠার পরে ছেলেটি জানায় সে বিহার থেকে এসেছে, অমুক গ্রামে তার বাড়ি, তবে কী ভাবে সে ট্রেনে উঠে কলকাতায় পৌঁছেছে সে সব কিছুই তার স্মরণে নেই৷ তার কয়েক দিন পরেই ঘরের ছেলে ঘরেও ফিরে যায়৷

ফ্যাশন ডিজাইনার অগ্নিমিত্রার কথায়, ‘একদিন সকালে ছেলেকে ইস্কুলে পৌঁছতে যাওয়ার সময় চোখে পড়ল এজেসি বোস রোডের ফ্লাই-ওভারের তলায় একজন মহিলা শুয়ে আছেন৷ সম্পূর্ণ বিবস্ত্র৷ তাঁর পাশ দিয়ে লোকে হেঁটে যাচ্ছে, হুশ হুশ করে একটার পর একটা গাড়ি বেরিয়ে যাচ্ছে, মহিলাকে দেখছে সবাই, কিন্তু কেউই কিছু করছে না৷ পর পর দু’দিন এ দৃশ্য দেখে মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল৷ ঈশ্বর সঙ্কল্পে ফোন করে জানালাম তারা কিছু ব্যবস্থা করতে পারে কি না৷ ঘণ্টা দুয়েক পরেই ফোন শেক্সপিয়র থানা থেকে, বড়বাবু জানালেন, মহিলাকে তাঁরা উদ্ধার করে থানায় এনেছেন, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র তৈরি হয়ে যাওয়ার পরে তাঁকে ঈশ্বর সঙ্কল্পের আশ্রয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হবে৷’

কোয়েল কিংবা অগ্নিমিত্রার মতো আপনিও যদি ফুটপাথে অথবা রাস্তায় এমন কোনও অসহায়, আর্তের সন্ধান পান যাঁকে দেখে মনে হচ্ছে মানসিক ভারসাম্যহীন, চিকিৎসা এবং আশ্রয় দুটোরই প্রয়োজন, ঈশ্বর সঙ্কল্পের সাহায্যপ্রার্থী হতে পারেন৷ আমার বিশ্বাস নিশ্চয়ই সাড়া পাবেন৷ কেননা এ ভাবে অসহায় মানসিক রোগীদের রাস্তা থেকে তুলে এনে তাদের চিকিৎসা, আশ্রয়, সামাজিক পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করাটাই এই স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানটির প্রধান কাজ৷ আইসিসিআর মঞ্চে সংগঠনের বার্ষিক অনুষ্ঠানে যাঁরা দিব্যি চিড়িতন, হরতন, ইস্কাবন সেজে, অতি সনাতন ছন্দে ‘তাসের দেশ’ মঞ্চস্থ করলেন, শুনলাম তাঁদের মধ্যে বেশ কয়েকজনের, ছয় মাস আগে পর্যন্ত ঠিকানা ছিল কেয়ার অব ফুটপাথ৷

ঈশ্বর সঙ্কল্প দক্ষিণ কলকাতার একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন৷ কলকাতাকে দেশের সর্বোত্তম মানসিক স্বাস্থ্য বান্ধব শহর হিসেবে গড়ে তোলা এর স্বপ্ন এবং তা সাকার করার পথে এই অল্প সময়েই এই সংগঠনটি অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছে হোপ ফাউন্ডেশন, কলকাতা পুরসভা, কলকাতা পুলিশ, রাজ্য সরকার এবং অসংখ্য শুভানুধ্যায়ীর আনুকূল্যে৷ তাদের উদ্যোগে শুরু হয়েছে বেশ কয়েকটি প্রজেক্ট যাদের প্রত্যেকটিরই লক্ষ্য নিরাশ্রয় ও মানসিক অসুখে বিপন্ন মানুষের কাছে যে ভাবে হোক পৌঁছে যাওয়া৷

যেমন ধরা যাক ‘নয়া দৌড়’, ঈশ্বর সঙ্কল্পের সবচেয়ে পুরোনো এবং বোধহয় কার্যকর প্রকল্প৷ শহরের কোথাও কোনও মানসিক ভারসামহীন অনাহারে-অবহেলায় দিন গুজরান করছেন খবর পেলেই এঁদের উদ্যোগে ডাক্তার, কাউন্সেলর এবং সমাজসেবীদের দল ছুটে যায় অকুস্থলে৷ সেখানেই রোগীর প্রাথমিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরে অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করা হয়৷ যদি এঁরা মনে করেন স্থানীয় সহৃদয় মানুষজন কিংবা পাড়ার ক্লাবের সদস্যদের তত্ত্বাবধানে ফুটপাথে রেখেই রোগীর ওষুধপত্র, পথ্য, জামাকাপড় ইত্যাদির ব্যবস্থা করা সম্ভব তাহলে সেই ব্যবস্থা নতুবা তাদের হোমে পুনর্বাসন৷ এই পরীক্ষার সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ দিকটি হল রোগীর চৌহদ্দির মধ্যেই কাউকে না কাউকে ঠিক পাওয়া যায় যিনি নিজের দারিদ্র বা নানাবিধ নিজস্ব সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও মনুষ্যত্বের পরীক্ষায় সসম্মানে উত্তীর্ণ হন৷ এ ভাবে চিকিৎসায় সাড়া দিয়ে যাঁরা সুস্থ হয়ে ওঠেন, প্রথমেই চেষ্টা করা হয় তাঁদের সঙ্গে হারিয়ে যাওয়া পরিবারের পুনর্মিলনের৷ যাঁদের ক্ষেত্রে একান্ত ভাবেই সেটা সম্ভব নয়, তাঁদের জন্য চেষ্টা করা হয় কোনও না কোনও কর্মসংস্থানের যাতে আত্মমর্যাদা নিয়ে তাঁরা দিন গুজরান করতে পারেন৷ এই সংগঠনের অন্যতম স্তম্ভ শর্বানী দাস রায় জানালেন, এ ভাবে সাত বছরে তাঁরা অন্তত ২০০০ মানুষের সুস্থ, স্বাভাবিক জীবন ফিরিয়ে দিতে পেরেছেন৷

মুকেশের কাহিনি শুনুন৷ মুদিয়ালি রোডের কাছে এক গলিতে ছিল তার ঠিকানা, খালি গায়ে সেখানে সে সারাদিন বসে থাকত। কখনও নিজের মনে কেবলই হেসে চলত অথবা হঠাৎ ক্রুদ্ধ হলে হাতের কাছে যা পেত সেটা নিয়েই দৌড় শুরু করত লোককে ভয় দেখাতে৷ সঙ্গে অকথ্য গালিগালাজ৷ কখনও-সখনও সে এমন হিংস্র হয়ে উঠত, এমন এলোপাথাড়ি ঢিল পাটকেল ছুড়ত যে ভয়ে তার ধারে কাছে কেউ যেতে পারত না৷ ২০১০ সালের কোনও একটা সময় তার কথা পৌঁছয় ঈশ্বর সঙ্কল্পে৷ প্রাথমিক পরীক্ষাতেই স্পষ্ট হয়ে যায় মুকেশ তীব্র স্কিজোফ্রেনিয়ার রোগী৷ চিকিৎসা চলতে চলতে পাড়ার নেশুড়েদের পাল্লায় পড়ে সে আবার মাদকের নেশা শুরু করে দেয়৷ পাড়ার কয়েক জন সহৃদয় মানুষকে সঙ্গে নিয়ে ঈশ্বরসঙ্কল্প তবু হাল ছাড়েনি৷ ধীরে ধীরে মুকেশের উপসর্গগুলি কমতে থাকে, শেষ পর্যন্ত নয় দশ-মাসের মাথায় সে সুস্থ হয়ে যায়৷ তাতে পাড়ার লোকেরা আরও উৎসাহিত বোধ করতে শুরু করেন, একটা রাস্তার খাবারের দোকানে তার চাকরিও হয়৷ কিছুদিন পরেই মুকেশ ফিরে যায় টালিগঞ্জে নিজের বাড়িতে৷ বাড়ির লোকজনের সাহায্যে সে এখন নিজেই একটা রিকশর মালিক, সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য উপার্জনক্ষম অভিভাবক৷ রাস্তায় রিকশ চালাতে চালাতে ঈশ্বর সঙ্কল্পের অ্যাম্বুলেন্স দেখলেই সে আনন্দে আত্মহারা হয়ে হাত নাড়তে থাকে৷ সম্প্রতি অ্যাম্বুলেন্স থামিয়ে সে নিবেদন করেছে, ‘ডাক্তারবাবু আমার এক তুতো ভাইও না পাগল হয়ে গিয়েছে৷ ওকে একটু দেখবেন?’

ঈশ্বর সঙ্কল্পের তত্ত্বাবধানে রাস্তার পরিত্যক্ত রোগীটির সেবায় পল্লিবাসীদের মধ্যে যে বা যাঁরা এগিয়ে আসেন, তাঁদের কেতাবি নাম ‘কেয়ার গিভার’৷ গত সাত বছর ধরে গোটা শহরে এ ভাবে অসংখ্য কেয়ার গিভারকে সঙ্ঘবদ্ধ করে তাদের প্রয়োজনীয় শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে৷ চালু হয়েছে তাঁদের কাজের স্বীকৃতি ও পুরস্কারের ব্যবস্থাও৷ যেমন মাঝেরহাট এলাকায় সারওয়ারি বেগম নামের এক মধ্যবয়স্কা রমণী কলিম নামে এক রোগীর কেয়ার গিভার৷ স্বামীর মৃত্যুর পরে নিজেই একটা দর্জির দোকান খুলে সে নিজের এবং দুই সন্তানের গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থা করে৷ সেখানেই কলিম ঘুরে বেড়াত সারা গায়ে গাড়ির মোবিল মেখে আর গাঁদা ফুলের মালা গলায় চাপিয়ে৷ তাঁর সন্ধান পাওয়ার পরে ঈশ্বর সঙ্কল্প পৌঁছে যায় কলিমের কাছে৷ তাঁর চিকিৎসায় সহায়তা করার জন্য তারা খোঁজ নিতে শুরু করে কলিমের পাড়ায়৷ সবাই আপত্তি জানায় এবং গোটা মহল্লার প্রতিবাদকে থোড়াই কেয়ার করে এগিয়ে আসেন সারওয়ারি একা৷ তাঁর সস্নেহ আশ্রয়েই ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠে কলিম এখন মাসে তিন হাজার টাকা মাইনের নিরাপত্তা রক্ষীর কাজ করেন৷ সারওয়ারির সঙ্গে সম্পর্ক একেবারেই ছিন্ন করেনি কলিম, মাঝে মাঝে গিয়ে তাঁর সঙ্গে সময় কাটান৷ সারওয়ারি এখন রাস্তার ছেলেকে একটা শাদি দিতে বেজায় মরিয়া৷ সম্প্রতি ঈশ্বর সঙ্কল্পে এসে বেগম অনুরোধ করেছেন, ‘কলিমের জন্য একটা মেয়ে দেখে দিতে পারেন?’

এ সবের সঙ্গে আছে পুনর্বাসন কেন্দ্র, আছে শর্বরী নামের এক দিন-রাতের আশ্রয়৷ সম্প্রতি কলকাতার দু’টি ওয়ার্ডে পুরসভার প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকেই এলাকার মানুষের মানসিক চিকিৎসার ব্যবস্থাও তাঁরা শুরু করেছেন৷ উদ্দেশ্য মানসিক অসুখ সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানো এবং হাতের কাছেই উপযুক্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা৷ ঈশ্বর সঙ্কল্পের প্রতিজ্ঞা অচিরেই এই প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র নির্ভর এই সমান্তরাল চিকিৎসা ব্যবস্থাটিকে তাঁরা কলকাতার ১৪১টি ওয়ার্ডেই ছড়িয়ে দেবেন৷

তাঁরা পারবেন৷ আরও দ্রুত আরও কার্যকর ভাবে পারবেন যদি আমি আপনিও বাড়িয়ে দিই সাহায্যের হাত৷ এটুকু হলফ করে বলতে পারি, বৃথা যাবে না সে সাহায্য, আপনার সাহায্যে হাসি ফুটবে আরও অসংখ্য মুকেশের ঠোঁটে, জীবনে পুনর্বাসিত হতে পারবে আরও হাজার হাজার কলিম৷ জীবনে পরম প্রাপ্তির সন্ধান মেলে কিন্তু দেওয়ার মাধ্যমেই৷

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *