logo

নীরেন কাকা

  • January 1st, 2021
Reminiscence, Suman Nama

নীরেন কাকা

নীরেন কাকা

সুমন চট্টোপাধ্যায়

গত চোদ্দ মাস, মানে আমার হাজতবাসের কালে বাংলা সাহিত্য জগতের দুই উজ্জ্বল নক্ষত্র নিভে গেলেন—নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, নবনীতা দেব সেন! দু’জনেই আমার বড্ড প্রিয় স্বজন ছিলেন।

পিতৃবন্ধু বলে নীরেনবাবুকে আমি নীরেনকাকা বলে ডাকতাম।যেমন সন্তোষ কুমার ঘোষ ছিলেন ‘বাদলকাকা’ , গৌরকিশোর ছিলেন “গৌরকাকা।” কিন্তু সেটা বড় কথা নয়।

ছেলেবেলায়, ইস্কুলে পড়ার সময় আমি দু-চারটে ছোটগল্প লেখার চেষ্টা করেছিলাম, ছোটদের জন্যই। প্রথম গল্পটি নিয়ে সাহস করে চলে গিয়েছিলাম নীরেনকাকার কাছ, তিনি তখন সাপ্তাহিক আনন্দমেলা সম্পাদনা করতেন। মিনিট পনেরো ছিলাম তাঁর ঘরে.এত সিগারেটের ধোঁয়া যে আমার চোখ জ্বালা করছিল। টেবিলে দেখলাম তিনটে চার্মস সিগারেটের বড় প্যাকেট একটার ওপর একটা রাখা আছে। আমাদের ছেলেবেলায় কবি-শিল্পী-আঁতেল হওয়ার পরিচয়পত্র ছিল চারমিনার টানা। অসম্ভব কড়া তামাক, ফিলটারহীন সিগারেট! একটা সময় চারমিনার বাজার থেকে উধাও হয়ে গেল, এল চার্মস! চারমিনারখোরেরা অনুগত ভৃত্যের মতো এই নতুন ব্র্যান্ডের দিকেই দলে দলে ঢলে পড়লেন. সেই প্রথম দেখেছিলাম চেইন-স্মোকার হওয়া কাকে বলে! অন্ধকার ধোঁয়াটে ঘরে সামান্য কুশল বিনিময়ের পরেই নীরেনকাকা তাঁর সুরেলা গলায় বললেন, “গপ্পো লিখেছিস? খুব ভাল কথা! তা বাবা এখনই তো পড়তে পারবনা, তাই ওটা আমার কাছে রেখে যা কেমন!” তাই করলাম। মাস দেড়েকের মধ্যে দেখলাম গল্পটি খুব যত্ন করে, রঙিন ছবি দিয়ে ছাপানো হয়েছে। কী যে আনন্দ হয়েছিল! তারপরে কত কিছুই তো লিখলাম, প্রথম গল্প প্রকাশের মতো আনন্দ তো আর কিছুতে পেলামনা।

তারপর একদিন আমিও সাদা বাড়িতে চাকরি করতে ঢুকলাম, হলাম নীরেনকাকার সহকর্মী। কিছুদিন পরে তিনি আর আনন্দমেলার সম্পাদক রইলেন না, হলেন আনন্দবাজারের মাস্টার মশাই। রোজ সকালে তাঁর কাজ ছিল কাগজটি আদ্যোপান্ত পড়া হাতে একটা লাল কলম নিয়ে। যেখানেই বানান ভুল অথবা বাক্যের গঠনে ভুল সেখানেই গোল করা লাল দাগ, সঙ্গে সংশোধন আর মজার মজার মন্তব্য। ১৯৯৩ সালে আমি আনন্দবাজারের দায়িত্ব নেওয়ার পরে নীরেনকাকার লাল কলমকে সবচেয়ে ভয় পেতাম, সহকর্মীদের বলতাম এমন নির্ভুল কাগজ করতে হবে যাতে নীরেনকাকা কলমের ডগা পর্যন্ত ছোঁয়াতে না পারেন। অবাস্তব লক্ষ্য ছিল তবু কোনও কোনও দিন হয়েও যেত নির্ভুল কাগজ। সেদিন কলার উঁচু করে নীরেনকাকার সঙ্গে আড্ডা দিতে যেতাম। ওঁর সঙ্গে কথা বলা মানেই ছিল নিজেকে বানান বিষয়ে আরও একটু বেশি শিক্ষিত করে তোলা। ওঁর লেখা, “কী লিখবেন, কেন লিখবেন” বইটি সব বঙ্গসন্তানের হাতের কাছে থাকা উচিত। বাংলা বানান ও তার ব্যবহার নিয়ে এমন সুখপাঠ্য বই আর দ্বিতীয়টি নেই।

ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের পরে সাদাবাড়ির অন্দরমহলের হকিকৎ সম্পূর্ন বদলে যায়, নীরেনকাকা আর রমাপদ চৌধুরী আমাদের পড়শি হয়ে পড়েন।চারতলায় বার্তা বিভাগের উল্টো দিকের ঘরে উঠে আসেন ওঁরা দু’জন। যতক্ষণ অফিসে থাকতেন মনে হত যেন মানিক-জোড়।সাদাবাড়ির ভিতরে তখন ধূমপান নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছে, বিড়িখোররা পড়ে গিয়েছেন বেজায় মুশকিলে।নীরেনকাকা আর রমাপদদাকে তাতে দমানো যায়নি, দিনের মধ্যে পাঁচ ছয়বার তাঁরা একসঙ্গে লিফটে করে নীচে নামতেন, সিগারেটে শেষ টান দিয়ে আবার ওপরে উঠে যেতেন!

সাদাবাড়িতে একটা ছোট্ট সম্প্রদায় বরাবরই আছে যাদের আমরা রসিকতা করে নাম দিয়েছিলাম ‘টি কে সি”, টিল খাটিয়া কামস। অর্থাৎ যাঁদের অবসর নিতে নেই! এই টি কে সি-র দলে দুটি বড় নাম হলেন নীরেন কাকা আর রমাপদদা।অবসরের বয়স চলে যাওয়ার পরে এঁরা কে কত বছর কাজ করে গিয়েছেন বলতে পারবনা।

এমন জানা নিয়মে দৈবাৎ একদিন ব্যতিক্রম হল! বিকেল চারটে নাগাদ ওঁদের ঘরে গিয়ে দেখি নীরেনকাকা তাক থেকে নিজের বইগুলো বের করে সঙ্গের ঝোলায় ঢোকাচ্ছেন। গম্ভীর থমথমে মুখ! আমাকে দেখে বেশ নির্লিপ্ত গলায় বললেন,”কাল থেকে আমাকে আর পাবিনা তোরা! আজই আমার এই অফিসে শেষ দিন!”

কিছুই বুঝতে না পেরে বিহ্বল আমি জানতে চাই হঠাৎ কী এমন হল যে নীরেনকাকাকে বিদায় নিতে হচ্ছে! পাশেই চেয়ারের ওপর ঠ্যাং-দুটো জোড়া করে বসে থাকা রমাপদদা রহস্যের কিনারা করে দিলেন। “ নীরেনের কনট্র্যাক্ট কোনও কারণে এবার রিনিউ হয়নি।”

সময় নষ্ট না করে আমি দৌড়ে ঢুকলাম অভীক সরকারের ঘরে, তাঁকে ঘটনাটা জানালাম। সঙ্গে সঙ্গে তিনি জিভ কেটে নীরেনকাকাকে ঘরে ডেকে পাঠালেন। তারপর যে সংলাপ সেখানে দাঁড়িয়ে শুনলাম তা মোটামুটি ছিল এই রকম!

অভীকবাবু- আরে এটা ক্ল্যারিকাল মিসটেক। আপনি ভাবলেন কী করে যে আপনাকে আমরা ছেড়ে দেব? আপনার সঙ্গে কী আমাদের মনিব-চাকর সম্পর্ক?

নীরেনকাকা- তা নয় তবে কনট্রাক্ট না পেলে……

কথা শেষ করতে দিলেননা অভীকবাবু। “ শুনুন নীরেনবাবু আপনি হলেন এই অফিসের বন্ডেড লেবার! আপনার মুক্তি নেই।”

হঠাৎ আমার মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল ,”এবার বুঝলেন তো নীরেনকাকা, খাটিয়া না আসা পর্যন্ত রোজ আপনাকে আমাদের মাস্টারি করে যেতে হবে। এবার চলুন, নীচে গিয়ে ভাঁড়ে চা খাই আর সিগারেট টানি!”

(ভুবনেশ্বর জেলে বসে লেখা)

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *