logo

হাফসোল-২

  • August 13th, 2022
Man-Woman

হাফসোল-২

ফ্রম হৃদয়হারি টু হৃদয়বিদারী

মৌমিতা তরণ

তখন ক্লাস সেভেন। সে বার অষ্টমীর দিন বন্ধুরা মিলে শাড়ি পরে মণ্ডপে গেছি অঞ্জলি দিতে। প্রথম পর্ব শেষ হয়ে দ্বিতীয় পর্বের অঞ্জলি শুরু হয়েছে। সকলের হাতে ফুল দিচ্ছে পাড়ার ছায়াদি, গৌতমদা আর একটা অল্পবয়সি অচেনা ছেলে। আমি দু’হাত মেলে ধরতে সে আমার হাতে ফুল গুঁজে দিল। সঙ্গে বেলপাতাও। চোখাচোখি হতে আমি অবাক। বাপরে! কে এই ছেলেটি? কী অপরূপ দেখতে! ঠিক যেন রাজপুত্র ! ধবধবে ফর্সা, টিকোলো নাক, মাথায় ঘন চুল। অঞ্জলি দেব কী, আমি তখন পাতালপুরীর ঘুমন্ত রাজকন্যা! ফুল নয়, মনে হচ্ছে রাজপুত্র যেন আমার হাতে জিয়নকাঠি ছুঁয়ে দিয়েছে। দ্বিতীয় দফার ফুল দিল সে আমার হাতে। ঠোঁটের কোণে তার মুচকি হাসি। ক্লাস ফোরেই সুনীলের ‘বুকের মধ্যে আগুন’ পড়ে ফেলেছি। এ বার মনে হল আমি যেন সেই উপন্যাসের ‘কুন্তলা’। অল্পবয়সি অচেনা ছেলেটি ‘সোমনাথ’। রেল ডাকাতি করে এসে আমার কাছে লুকোতে চাইছে৷ তোমরা ভাবছ আমি বুঝি বানিয়ে বানিয়ে বলছি এ সব! ক্লাস সেভেনের মেয়ে এত ম্যাচিওরড হয় নাকি!

বিশ্বাস করো, সে সময় আমরা এ রকমই ছিলাম। বিশেষ করে প্রেমের ব্যাপারে খুব সিরিয়াস থাকতাম। সব প্রেমিকই তখন গল্প থেকে উঠে আসা নায়ক। আর নিজেদেরকে নায়িকা ভাবাটাই ছিল নিয়ম। ওর মুচকি হাসিতে আমার মধ্যে কেমন যেন এক নায়িকা-টাইপ লজ্জা খেলে গেল। কোনওমতে তৃতীয় দফা অঞ্জলি সেরে বাড়ি চলে এলাম। ততক্ষণে আমার মনে কী সব যেন শুরু হয়েছে। কুকুরে সাঙ্ঘাতিক ভয় আমার। অথচ ঘেউ ঘেউ করা লালুকে দেখে এখন একটুও ভয় করছে না।

অষ্টমীর রাতে সেরা ড্রেসটা পরতে হয়। ব্ল্যাক বেলবটস আর পিংক টপ পরলাম। মণ্ডপে ধুনুচি নাচের প্রস্তুতি চলছে। মাইকে বাজছে শ্রাবন্তীর গান – ‘মধুপুরে পাশের বাড়িতে তুমি থাকতে...।’ মণ্ডপের সামনেই আমাদের বাড়ি। বাড়ির সিঁড়ির তলায় মাইক বাজানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। মণ্ডপ থেকে মনে হল, সকালের সেই অল্পবয়সি যেন আমাদের বাড়ির ভিতর ঢুকল। সারা দুপুর যাকে ভেবেছি, সে এখন আমার বাড়িতে! দৌড়ে বাড়ি চলে এলাম। 

হ্যাঁ, ঠিকই দেখেছি। এ তো সেই রাজপুত্তুর, বসে আছে মাইকের ঘরে৷ আমি কিন্তু তাকাইনি ওর দিকে। তবে ও যে আমায় দেখছে বুঝতে পারছি। ঘরে গিয়ে জল খেলাম। বেরিয়ে আসার সময় দেখলাম মন দিয়ে রেকর্ড বাছছে। আমি তাকাতেই মুখ তুলল এবং হাসল। কী সুন্দর দাঁতের সেটিং। ঘরোয়া পত্রিকাতে দেখা বিনোদ খান্নার ছবির মতো। ঘোরলাগা মন নিয়ে আবার মণ্ডপে এলাম। মাইকে তখন মান্না দে-র গান , ‘ও কেন এত সুন্দরী হল....।’

নবমীতে পাড়ার সবাই মিলে একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া হবে। মুখার্জি জেঠু আমাদের বললেন, ‘খাওয়ার সময় তোরা সবাইকে জল দিবি।’ প্রথম ব্যাচ খাচ্ছে। জলের জগ আনতে গিয়ে দেখি রান্নার ওখানে আরও অনেকের সঙ্গে 'অল্পবয়সি দাঁড়িয়ে আছে। হাতে বেগুনির ট্রে। হঠাৎ কে যেন বলল, ‘ওরে মাখনা বেগুনি রাখ। যা গরম তুই দিতে পারবি না। হাতে ছ্যাঁকা খাবি।’

মাখনা! কে মাখনা!

আমায় চমকে দিয়ে ‘অল্পবয়সি’ তখন বলছে, ‘না গো পাপাইদা তুমি চিন্তা কইর্যোর না। আমি পারুম। দ্যাশে তো এইর থিক্যাও গরম ব্যাগুনি, ইলশা ভাজা হজ্ঞলের পাতে দিসি।’

আর এক মিনিট সময় নষ্ট না করে সেখান থেকে চলে এলাম। একটু পরে পাপাইদাকে সামনে পেয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কে গো ঐ ছেলেটা যাকে তুমি গরম বেগুনি দিতে মানা করলে?’

‘আরে ও তো আমাদের কাঁকনের ভাই মাখন। বাংলাদেশে থাকে। পুজোতে কাঁকনের বাড়ি এসেছে।’ ইস কী বিচ্ছিরি নাম — মাখন! তার উপর ওরকম বাঙাল কথা বলে।

নবমীর সন্ধিপুজোয় ওই মাখন না মাখনাকে দেখেছিলাম একটা একটা করে প্রদীপে সলতে পরাচ্ছে। বন্ধু পূরবীকে দিয়ে আমাকে ডেকেছিল। আমি ভুলেও সেদিকে যাইনি।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *