- August 13th, 2022
বনের পাখি, খাঁচার পাখি
বনের পাখি, খাঁচার পাখি
সুমন চট্টোপাধ্যায়
ছেলেবলায় আমার বাড়িতে একেবারেই মন টিকত না, যে কোনও ছুতোয় বাইরে পালিয়ে যেতাম। সংসারের কয়েকটা কাজ আমার জন্য বরাদ্দ ছিল, তার জন্য পালানোর প্রয়োজন হত না। যেমন সকালবেলায় হরিণঘাটার জালি দেওয়া বুথ থেকে হলুদ কার্ড দেখিয়ে সোনালি ছিপি লাগানো ডবল টোন দুধ আনা, রেশন তোলা, কেরোসিনের জন্য লাইন দেওয়া, চাকিতে নিয়ে গিয়ে গম ভাঙানো, পাড়ার লন্ড্রিতে ময়লা কাপড়ের পুঁটলি নামিয়ে দেওয়া। এই জাতীয় লাইসেন্স প্রাপ্ত খাটনির কাজে মজা ছিল না, যেটা ছিল বাড়ির কাউকে কিচ্ছুটি না বলে টুক করে বেরিয়ে যাওয়ায়।
আমার বাবার কন্ঠস্বর যে কোনও মানুষের হৃদকম্পন ধরিয়ে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট ছিল। খুব ছেলেবেলায় আমি হয়তো পাড়ায় খেলতে গিয়ে বাড়ি ফিরতে দেরি করছি, বাবা বারান্দায় দাঁড়িয়ে কেবল কয়েকবার আমার নামটি ধরে সজোরে হাঁক দিতেন। আমি বুঝে যেতাম, এক্ষুনি বাড়ি ফেরার দৌড় না লাগালে শারীরিক নিগ্রহের সম্ভাবনা অতীব উজ্জ্বল। কেন জানি না, পেটানোর ব্যাপারে বাবা ছিলেন এক্কেবারে নৃশংস, মারতেন যখন তাঁর ণত্ব-ষত্ব জ্ঞান লোপ পেত। বাবার ব্যর্থতা হল, এত লাঠ্যৌষধি প্রয়োগ করেও তিনি কুকুরের লেজ সোজা করতে পারেননি, আমার বেয়াদপি তাতে বন্ধ হয়নি।
নিজে মার খেতে খেতে বড় হয়েছি বলে আমি নিজের পুত্র-কন্যার গায়ে কখনও হাত তুলিনি।
বয়স বাড়লে অভিভাবকের নজরদারি এমনিতেই শিথিল হয়ে আসে, একটা সময়ের পর আমার বাড়িতে থাকা-না থাকা নিয়ে বাবা মাথা ঘামানোই বন্ধ করে দিয়েছিলেন। বাবার কাছে তখন আমার পলায়নী মনোবৃত্তি রীতিমতো রসিকতার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আমি বাড়িতে নেই এমন সময়ে পাড়ার এক বন্ধু জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বাবাকে প্রশ্ন করেছিল, ‘মেসোমশাই সুমন কী বাড়ি আছে?’ চোখের পলক পড়ার আগেই বাবার উত্তর, ‘সুমন তো এ বাড়িতে থাকে না, আসে।’
চুপিসারে বাইরে বেরোনোর পিছনে বেশিরভাগ সময়ই পূর্ব পরিকল্পনা থাকত না, বাড়িতে থাকতে থাকতে বোর হয়ে গিয়েছি, এই ভাবনাটুকুই ছিল যথেষ্ট। বন্ধুদের কারও দর্শন পেলে হয়তো তার সঙ্গে দু’দণ্ড আড্ডা মারতাম, কাউকে না পেলেও কুছ পরোয়া নেই। পাড়ার মোড়ের মিষ্টির দোকান থেকে এক ভাঁড় চা খেয়ে একটা সিগারেট ফোঁকার মধ্যে প্রায় স্বর্গীয় তৃপ্তি বোধ করতাম। তারপর মুখের গন্ধ চাপা দিতে পানের দোকান থেকে বড়-ছোট এলাচ মেশানো একটা মিষ্টি পান খেতেই হত। কলেজে ওঠার পরে অবশ্য আর শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টাই করতে হয়নি, নিজের ছোট্ট পড়ার ঘরের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ করে, ধূপকাঠি জ্বালিয়ে দিব্যি ধূম্রপান করা যেত। ততদিনে আমার স্ট্যাটাস মোটামুটি নির্ধারিত হয়ে গিয়েছে। ‘বাপে খেদানো মায়ে তাড়ানো।’
বাবা কথায় কথায় ভারী শব্দ ব্যবহার করতে ভালোবাসতেন। বলতেন আমার নাকি ‘বহির্মুখী মন’। উড়ু উড়ু মন বললে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেত না তবু শব্দ-চয়নের প্রশ্নে তিনি ছিলেন পাণিনি-পন্থী।
বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌকাঠ পেরোনোর সঙ্গে সঙ্গে মহানন্দে এমন একটি পেশায় যোগ দিলাম যা আমার বহির্মুখী মনের সঙ্গে ষোলো আনা মানানসই। একেবারে খাপে খাপ, কেদারের বাপ। রিপোর্টারির সুবাদে দেশে-বিদেশে চর্কি কেটেছি, বাড়িতে একটি স্যুটকেসে সর্বদা জামা-কাপড় গুছিয়ে রাখা থাকত যাতে কোথাও যাওয়ার আদেশ এলে অযথা কাল বিলম্ব না হয়। দিল্লিতে থাকাকালীন এমনও সময় গিয়েছে যখন আমি মাসের মধ্যে কুড়ি-বাইশ দিনই বাইরে বাইরে কাটাতাম, দারা, পুত্র, পরিবার, তুমি কার, কে তোমার এমন একটা দার্শনিক ভাব করে। পেশায় নাম-ডাক তো হচ্ছে কিন্তু অলক্ষ্যে কত বড় মূল্য চোকাতে হচ্ছে টের পেলাম এক হৃদয় মোচড়ানো অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে।
সপ্তাহ তিনেক প্রাণ হাতে করে গৃহযুদ্ধের মধ্যে কাটিয়ে কাবুল থেকে দিল্লি ফিরছি। যমেরও অরুচি বলে বেঁচে বর্তে গিয়েছি যুদ্ধের মধ্যেও। আমার কন্যার তখন বছর তিনেক বয়স, হাতে-পায়ে চঞ্চল, দুষ্টুমিতে ভারতরত্ন। ফেরার আগের দিন বিকেলে কাবুলের বাজারে গিয়ে তার জন্য লাল টুকটুকে একটা ভেলভেটের স্কার্ট কিনলাম। ভাবলাম মেয়ের দারুণ পছন্দ হবে। দিল্লি ফিরে বাড়িতে ঢুকেই স্যুটকেস থেকে সেই উপহারটি বের করে মেয়েকে ডাকলাম। লাফালাফি করা কোন ছাড়, সে উপহারটির দিকে তাকিয়েও দেখল না। উল্টে এমন একটি প্রশ্ন জিজ্ঞেস করল, আমি স্রেফ বাকরুদ্ধ হয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকলাম।
বাবা, এ বার থেকে তুমি আমাদের বাড়িতে থাকবে তো?’
মেয়ের প্রশ্নটি এখন এতদিন পরেও গভীর ভাবে আমাকে নাড়া দেয়। তাৎক্ষণিক ভাবে এতটাই টলিয়ে দিয়েছিল, আমি ঘটনাটি নিয়ে আনন্দমেলায় একটি গল্প লিখেছিলাম। পিতৃ-সঙ্গ বঞ্চিত একমাত্র শিশু কন্যার অসহায় হতাশা আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছিল আসলে আমি মরীচিকার পিছনে দৌড়চ্ছি। তখন অবশ্য আর ফেরার উপায় নেই, শ্যাম আর কুলের মধ্যে প্রথম জনেই নিবেদিত প্রাণ।
রিপোর্টারি ছেড়ে সম্পাদনার কাজে থিতু হওয়ার পরে ঘনঘন বাইরে যেতে হয়নি ঠিকই কিন্তু সংসারে মন দেওয়া হয়েই ওঠেনি। মধ্যরাতের পরে বাড়ি ফিরে ফের মধ্যদিনের অনেক আগেই অফিসে চলে যাওয়া, আসল বাড়ি অফিসটাই, নিজের বাড়ি বড়জোর ট্রানজিট ক্যাম্প। অক্ষরে অক্ষরে মিলে গিয়েছিল বাবার মন্তব্য, ‘সুমন তো এ বাড়িতে থাকে না, আসে।’
টানা সাঁইত্রিশটি বছর বিরামহীন এই ভাবে কাটানোর পরে বছর আড়াই হল সেই আমার পায়ের তলার সর্ষেগুলো বেমালুম অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে, আমি বাধ্য হচ্ছি পুরোদস্তুর বন্দি জীবন কাটাতে। কী ভাবে ব্যাখ্যা করা উচিত আমার এই নির্মম পরিণতি? ওপরওয়ালার অভিশাপ? প্রকৃতির প্রতিশোধ নাকি শিশু-কন্যার দীর্ঘশ্বাস?


Arts and Literature
Bioscope
Columns
Green Field
Health World
Interviews
Investigation
Live Life King Size
Man-Woman
Memoir
Mind Matters
News
No Harm Knowing
Personal History
Real Simple
Save to Live
Suman Nama
Today in History
Translation
Trivia
Who Why What How


