logo

হাফসোল-১১

  • August 16th, 2022
Man-Woman

হাফসোল-১১

নচ্ছার পার্থেনিয়াম

ভাস্কর লেট

হাফ-সোল বিনে প্রেম নাই।

এ কি নেহাত হালের কথা? মোটেই না। স্বয়ং শেক্সপিয়র এই বিষয়ে তদ্বির রেখেছেন, প্রজন্মবাহিত হওয়ার জন্য আমাদের দিয়ে গিয়েছেন একটি সন্দীপিত অ্যাটেস্টেড কপি।

১৫৯৭। ‘রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট’। অ্যাক্ট ওয়ান। সিন ফোর। দুই বন্ধুর মধ্যে ‘এক্সচেঞ্জ’ চলছে। টাকাপয়সা বা বৈদেশিক বাণিজ্যের চাহিদাপত্র নয়। মতের, সহমর্মিতার।

বন্ধু মারকিউজিও বেজায় জোরাজুরি করছে নাচার জন্য বিষণ্ণ রোমিওকে। ‘Nay, gentle Romio, we must have you dance.’ এর উত্তরে ঘ্যানঘেনে ‘ন্যা’ বাগিয়ে রোমিও বলছে, ‘Not I, believe me. You have dancing shoes,/ With nimble soles; I have a soul of lead/ So stakes me to the ground I cannot move.’ অর্থাৎ, তুমি কী বুঝবে বন্ধু, তোমার জুতোটি যে কর্মতৎপর, অ্যাক্রোব্যাটিক। তোমার হৃদয়ের কথা সে শোনে। তাই তো এত সুন্দর নাচে তালে-তালে। কিন্তু আমার হৃদয়? কীসের তৈরি জানো, সিসের। নাচব কী, নড়তেই দেয় না। মাটি কামড়ে জমে থাকে। আসলে, রোমিও প্রেমে পড়েছে। ভালবাসার ভাইরাস তাকে এমন সংক্রামিত করেছে, নৃত্য-গীতের সহজাত আবেগ তার জিভে পানসে ঠেকছে। এই হল গিয়ে হাফ-সোলের মাহাত্ম্য!

শেক্সপিয়র মহাকবি, প্রতিভার সমুদ্দুর। তাই ‘সোল’ কথাটি দু’বার দু’ভাবে ব্যবহার করে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। পণ্ডিতরা তো ভেবেই চিৎপটাং। এই শেক্সপিয়র ভদ্রলোক ‘সোল’ মানে একবার করে দিলেন ‘জুতো’। আর-একবার সেটাকেই করে ছাড়লেন আত্মিক ধুকপুকানি, বাপ্রে, কী pun-রস।

কিন্তু আমাদের যৌবনের দাঁত যখন সবে উঠছে, অন গড, সাহেবি ভাষার এত মারপ্যাঁচ বুঝতাম না। হাফ-সোলের জন্য একটিই স্ট্যান্ডার্ড অর্থ বরাদ্দ ছিল। ‘দাগা’ খাওয়া। ভাই রে, রিজেক্ট করে দিল। কোনও না কোনও বন্ধু শুকনো মুখে এই কথাটি প্রতি দু’মাসে একবার করে বলবেই। অন্যরা শুনবে। মুচকি হাসবে, বা গম্ভীর থাকবে। অবধারিত ভাবে এরপর তার দিকে এগিয়ে দেবে সিগারেট, কাউন্টার। সগর্বে বলব, না সলজ্জে অধোবদন হয়ে স্বীকার করব বুঝতে পারছি না, তবে সত্য এই যে, হাফ-সোলের অর্থ বোঝার জন্য আমাদের শেক্সপিয়রের দ্বারস্থ হতে হয়নি। বেয়াড়া হরমোন, তাম্মা-তাম্মা বসন্ত, হিন্দি সিনেমা ও বটতলার বই অনেক বেশি প্রাঞ্জল করে দিয়েছিল যে, এই যৌবন লইয়া কী করিতে হইবে!

আবারও বলি, ‘হাফ-সোল’ না পেরিয়ে প্রেমে পৌঁছনো যায় না। যে ভাবে একবারও লালবাতি না খেয়ে অতি বড় সুপারফাস্ট ট্রেনও প্ল্যাটফর্ম পায় না হাওড়ায়। ব্যক্তি-ভেদে পরিস্থিতি বদলায়। পরিস্থিতি অনুযায়ী পাল্টে যায় অভিজ্ঞতার বিনুনি। তবে ‘প্রথম’ হাফ-সোলের প্রতি যদি কেউ বাস্তবেই নির্মল ও বিশ্বস্ত থাকতে চায়, তাকে বলতে হবে সেই অন্তর্গূঢ় আনচানের কথা, যখন তাল-তাল নীরেট বেদনা ধীরে-ধীরে বাষ্পে পরিণত হয়। যখন ছাইদানিতে মুখ দুমড়ে অনবরত জ্বলতে-পুড়তে থাকার যাতনায় দিন ও রাতের হুঁশ থাকে না। ইন্দ্রিয় হয় অ-নিয়ন্ত্রিত, আর মন হয় অতীন্দ্রিয়।

সর্বনাশের জন্য কোনও অছিলা লাগে না। 

তা-ও না হয় ধরে নিন, সেদিনও ছিল চৈত্রমাস। দিঘির ঘাটে ফেলে এসেছিলাম তার দু’টি চোখ। সেই দৃষ্টি আমার পিঠে কেন এখনও গেঁথে আছে? উতল হাওয়ার ঝামড়ানিতে, ঝিরঝিরে বৃষ্টির একঘেয়েমিতে, ছাতিম ফুলের ঘ্রাণে তার দৃষ্টিকোণ কেন আজও জ্যান্ত হয়ে তাকায়? অতীতকে মাটি-চাপা দিয়ে যতই সমান করে রাখতে চাই না কেন, ইতিহাসের ওপার থেকে চিরন্তন রোমিওটি ঠিক কঁকিয়ে ওঠে, ‘I have a soul of lead/ So stakes me to the ground I cannot move.’

‘প্রথম হাফ-সোল’ আসলে পার্থেনিয়ামের চারা। অনাক্রম্য। অনাক্রান্ত। অমীমাংসিত। সে শুধু জানে বংশগতি বজায় রাখতে। সেই দোষে এই নচ্ছারকে যদি পৃথিবী থেকে নির্বাসন দেওয়া হয়, জীবন কিন্তু গরিব ও মলিন হতে বাধ্য।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *