একটি স্বপ্নের জন্ম ও মৃত্যু
সুমন চট্টোপাধ্যায়
জয় জয় দেবী চরাচর সারে
কুচযুগ শোভিত মুক্তাহারে
বীণারঞ্জিত পুস্তকহস্তে
ভগবতী ভারতী দেবী নমোহস্তুতে।
সেদিনটা ছিল সরস্বতী পুজো।
তারিখ, ৯ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮১।
হাতেখড়ির জন্য এর চেয়ে আদর্শ দিন আর হতে পারে কি?
সাংবাদিকতায় হাতেখড়ি, তখনও ভূমিষ্ঠ না হওয়া একটি দৈনিক সংবাদপত্রে। নাম হবে ‘আজকাল’। ঠিকানা, ৯৬ রাজা রামমোহন রায় সরণি। তল্লাটের লোকে ডাকে ‘লাহা-বাড়ি’।
জাহাজের ক্যাপ্টেন গৌরকিশোর ঘোষ ওরফে রূপদর্শী, ওরফে গৌড়ানন্দ কবি। তাঁর ফার্স্ট মেট সমবয়সী এক বিহারি মুসলমান ভদ্রলোক, ঝুলিতে কোনো ডিগ্রি নেই অথচ চলমান এনসাইক্লোপিডিয়া, যতক্ষণ জেগে থাকেন ঠোঁটের কোনে ঝুলতে থাকে জ্বলন্ত চারমিনার, পকেটে পয়সা থাকলে গলা অবধি ব্লু রিবন্ড জিন। জল-টল মেশানোর ধার ধারতেন না, যদি বাপের বেটা হও ’নিট’ খাও, মেলা ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করতে এসো না!
ইনি হামদি বে। আমার দ্রোণাচার্য।
অধিনায়ক স্বপ্ন দেখা পাগল, সহ-অধিনায়ক জাতে মাতাল হলেও তালে ঠিক। একজন আঁকবেন নকশি কাঁথা, অন্যজন নিপুণ হাতে সেটা ফুটিয়ে তুলবেন। যুগলবন্দিতে তাল কাটবে ঘনঘন, ঝগড়া হবে, মতপার্থক্য হবে, দূরের ঘর থেকে পরিষ্কার শুনতে পাওয়া যাবে তারস্বরে হামদির তিরস্কার।
‘ঘৌর, আই অ্যাম সরি টু সে, ইউ আর এন ইনসাফারেবল ইডিয়ট।”
অনেকভাবে চেষ্টা করে দেখেছি, হামদির মুখ দিয়ে ‘গৌর’ শব্দটির সঠিক উচ্চারণ কিছুতেই বের করে আনতে পারিনি। আমি যত বলি ‘ঘৌর’ নয় ‘গৌর’, বিহারি বুড়ো ফোকলা দাঁতের মিষ্টি হাসি হেসে ততবারই প্রতিধ্বনি করেন, ‘ঘৌর’!
এই দুই বিস্ময়কর, দুর্লভ চরিত্রের নেতৃত্বে আমাদের ‘যাত্রা হল শুরু’। আমরা মানে এক ঝাঁক অল্পবয়সী ছেলেমেয়ে, যাদের গড় বয়স পঁচিশ-ছাব্বিশের বেশি হবে না। নিয়মরক্ষা করতে, অর্থাৎ শুরুর সময়ে বিভিন্ন বিভাগের হাল ধরতে, কয়েকজন বয়স্ক মানুষকেও ডেকে আনা হয়েছিল, যৌবনের উদ্দামতার মধ্যে তাঁরা কেমন যেন নিজেদের সিঁটিয়ে রাখতেন।
গৌরকিশোর বিশ্বাস করতেন, জগতে সত্যিকারের নতুন কিছু করতে হলে দামড়াদের দূরে সরিয়ে রাখতে হবে। এই বিশ্বাস থেকেই তিনি আনকোরা, অনভিজ্ঞ, সবে কলেজ পাশ ছেলেপিলেদের সুযোগ দিয়েছিলেন। বেশি বয়সের লোক মানেই নতুন চোখে, নতুন ভাবে, নতুন বিশ্বকে দেখতে না পারা। বয়স্ক মানে সেই লোক যে নিজের পুরোনো বিশ্বাস আর সংস্কারকে ঝোলায় বন্দি করে পিঠে ফেলে রেখে সর্বত্রগামী, যাকে নতুন করে কিছু বোঝানো বা শেখানো মানে ভস্মে ঘি ঢালা। তাদেরব দলে চাই টগবগে যৌবনের কয়েকটি ঘোড়া যারা বেড়া ভাঙতে পিছপা হবে না, নতুন সৃষ্টির নেশায় বুঁদ হয়ে থাকবে, স্বেচ্ছাচারের মধ্যে খুঁজে নেবে অনির্বচনীয় আনন্দ। আমাদের প্রতি গৌরকিশোরের অঘোষিত আবেদনটি ছিল, ‘আমি যা ভেবেছি তা যে ভুল নয়, তোমরা তা প্রমাণ করো তো দেখি!’
আমরা জান বাজি রেখে প্রমাণ দিতে চেয়েছিলাম, অচিরেই স্বপ্নভঙ্গ হয়ে গেল গৌড়ানন্দ কবি তাঁর সহ-কবিয়ালকে নিয়ে একদিন হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়ে গেলেন। নাবালক অবস্থাতেই স্বপ্নের মৃত্যু হল।
কেবল আজকালে নয়, গোটা বাংলা সাংবাদিকতায়।
এখনও ভেবে বিস্মিত হই, অচিরেই নির্গমনের দিন চলে আসতে পারে, জীবনের বিবিধ বিচিত্র অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ গৌরকিশোর ঘোষের কি এইটুকু কাণ্ডজ্ঞান ছিল না? হামদির অবশ্যই ছিল, আমাদের শিক্ষানবিশির প্রথম দিনেই তিনি তা লিখিতভাবে জানিয়ে দিয়েছিলেন, ‘Disabuse yourself of such fantasies as freedom of the press. Freedom of the press means freedom of the publishers to publish’। পাবলিশার বলতে এখানে প্রকাশক নয় বুঝতে হবে মালিককে।
আজকালের তদানীন্তন মালিক, আমেরিকা-প্রবাসী অভীক ঘোষের সঙ্গে গৌরকিশোরের দূরত্ব বাড়ছে, আমি সেটা আন্দাজ করতে পারতাম। কলকাতায় এলে তিনি জামির লেনের প্রাসাদোপম বাড়িতে সম্পাদকীয় বিভাগের লোকজনের সঙ্গে মাঝেমাঝেই মিটিং করতেন। সেখানে আমারও ডাক পড়ত, আমিই ছিলাম সর্ব-কনিষ্ঠ প্রতিনিধি। নেহাত প্রয়োজন না হলে আমি মুখ খুলতাম না, আড়চোখে বাকিদের মনোভাব, শরীরের ভাষা বোঝার চেষ্টা করতাম। হামদি দার্শনিকের মতো নির্লিপ্ত, ভাবলেশহীন মুখে স্পিকটি নট হয়ে বসে থাকত, অফিসে ফেরার সময় গাড়িতে রাগে গজরাতে গজরাতে বলত, ‘ What a bloody circus!’
অভীক ঘোষ সুদর্শন মানুষ ছিলেন, মার্কিন উচ্চারণে ইংরেজি বলতেন, বাংলাতেও অস্বচ্ছন্দ ছিলেন না। তাঁর ঠোঁটে সারাটা সময় একটা জ্বলন্ত পাইপ, বিদেশি তামাকের সুরভি ঘরে ছড়িয়ে পড়ত, আমি বসে বসে সেই সুগন্ধের ঘ্রাণ নিতাম তারিয়ে তারিয়ে। অভীক ঘোষের স্মার্ট চালচলন দেখেও আমার মনে হত ভদ্রলোক একজন আপস্টার্ট, পয়সা আছে, পেটে বিদ্যে নেই, খবরের কাগজের এ বি সি ডি-ও জানেন না। তা হোক, তিনিই তো ছিলেন আমার অন্নদাতা! মালিক হলেন ব্রিটেনের রাজার মতো, কিং ক্যান ডু নো রং।
মালিকের সঙ্গে গৌরকিশোরের সংঘাতের কেন্দ্রে ছিলেন এক এবং অদ্বিতীয় হামদি বে। হামদির তিরিক্ষি মেজাজ, যা মুখে আসে সেটাই বলে দেওয়া, অফিসে বসেই মদ্যপান, হঠাৎ নাক ডেকে ঘুমোতে শুরু করে দেওয়া, ঘুমের মধ্যে প্যান্টে পেচ্ছাপ করে ফেলা, তার দুর্গন্ধ, হামদিকে ক্রমশই একঘরে করে ফেলেছিল। অফিসে তাঁর উপস্থিতি অনেকের কাছেই মনে হত জীবন্ত উপদ্রব। ফলে আজকালের ভিতরে হামদি-বিরোধী হাওয়া ক্রমশ জোরদার হচ্ছিল, মালিকের কান ভাঙানো শুরু হয়েছিল পুরোদমে।
বন্ধুর কৃতকর্ম বা চারিত্রিক দুর্বলতার কথা গৌরকিশোর জানতেন না এমন নয়, তাঁর কাছে গিয়েও অনেকে হামদির নামে নালিশ জানাত যে। গৌরকিশোর খুব মন দিয়ে শোনার ভান করতেন, অভিযোগকারী বুঝতেও পারত না সম্পাদক আসলে বন্ধুর নিন্দামন্দ এক কান দিয়ে শুনে অন্য কান গিয়ে বের করে গিচ্ছেন। বন্ধুপ্রীতি তো ছিলই, গৌরকিশোরের কাছে তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল নিজের প্রত্যয়। তিনি মনে করতেন অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের প্রশিক্ষক হিসেবে হামদির সমগোত্রীয় আর একজনকেও কলকাতায় খুঁজে পাওয়া যাবে না। সুতরাং আজকালের স্বার্থেই হামদির থাকা প্রয়োজন এবং তিনি থাকবেন। কাগজে কে থাকবে, কে থাকবেনা সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার একমাত্র সার্বভৌম অধিকার সম্পাদকের, মালিকের নয়।
মানে মালিক যতদিন তা মেনে নেবেন, ততদিন।
সহকর্মীরা তাঁকে ভয় করে বা অপছন্দ করে, হামদি নিজে কি সেকথা বুঝতেন না? বুঝতেন তো বটেই কিন্তু গ্রাহ্যের মধ্যে আনতেন না। অস্থিমজ্জায় বোহেমিয়ান হামদি স্বভাবে ছিলেন এতটাই একরোখা, বেপরোয়া আর স্বেচ্ছাচারী। রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় যখন চাকরি করতে প্রথমবার আজকালে আসেন, গৌরকিশোর তাঁকে হামদির সঙ্গে দেখা করতে পাঠিয়েছিলেন। হামদির আলুথালু পোশাক, রুক্ষ মেজাজ, কথায় কথায় দাবড়ানি শুনে রঞ্জনদা ভয়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন, আর আজকাল-মুখো হননি। বেশ কিছুদিন পরে গৌরকিশোর নিজে উদ্যোগ নিয়ে তাঁকে ফিরিয়ে আনেন। ফিরে আসার পরেও হামদি নামের ব্রহ্মদত্যির ভয় রঞ্জনদাকে তাড়া করে বেড়াত। আমি সেজন্য সুযোগ পেলেই রঞ্জনদার পিছনে লাগতাম আর হামদির নাম করে ভয় দেখাতাম!
হামদি স্টেটসম্যান থেকে অবসর নেওয়ার পরে আজকালে এসেছিলেন। তিনি আদতে বিহারের ছাপড়া জেলার লোক। লেখাপড়া অসম্পূর্ণ রেখেই একদিন তিনি কলকাতা গামী রেলগাড়িতে চড়ে বসেন আর ফেরেননি। এই ব্যতিক্রমী তরুণ প্রতিভাকে প্রথমে চিনতে পেরেছিলেন লেনিনের সঙ্গে পাঞ্জা লড়া এক যশস্বী বাঙালি- মানবেন্দ্রনাথ রায়। হামদির প্রথম চাকরি এম এন রায়ের কাগজ ‘দ্য কোয়েস্টে’। তারপর কর্মজীবনের বেশিরভাগটাই কেটেছে স্টেটসম্যানে, কখনও রাঁচি, কখনও শিলং কখনও আবার কলকাতায়। হামদি জীবনে তিন নারীর সঙ্গে থেকেছেন কাউকে বিয়ে করেননি। গল্ফক্লাব রোডে একটা ফ্ল্যাটে তাঁর কন্যা থাকত কিন্তু হামদি সেখানে না থেকে জ্যোতির্ময় দত্তের পরিবারের সঙ্গে থাকতেন। স্টেটসম্যানে কাজ করতে গিয়ে জ্যোতিদা হামদির শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন, গুরুর শেষ নিঃশ্বাসটুকুও পড়েছিল শিষ্যের কোলে মাথা রেখেই। পরকে আপন করে নেওয়ার দত্তবাড়ির সেই কাহিনিও প্রায় অবিশ্বাস্য। ক্যান্সারের কাছে হার মেনে হামদি যেদিন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন, চশমা, এক জোড়া ময়লা জামা ছাড়া সম্বল বলতে আর কিছুই ছিল না।
মৃত্যুর বেশ কিছুদিন আগে আমি গৌরকিশোরের সঙ্গে জ্যোতিদার বাড়ি গিয়েছিলাম হামদির সঙ্গে দেখা করতে। সেই শেষ দেখা। আমি তখন দিল্লিতে কর্মরত, আনন্দবাজার ব্যুরোয়। যাওয়ার পথে বন্ধুর জন্য এক বোতল জিন কিনলেন গৌরকিশোর। সেটা দেখতে পেয়ে অসুস্খ হামদির চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে উঠল। তিনি তখন বাকশক্তি রহিত, গলায় একটা বড়ো ফুটো, তার গা দিয়ে শ্লেষ্মা গড়াচ্ছে। গড়াক, তাই বলে বোতলের পানীয় বোতলেই থেকে যাবে তা তো আর হতে পারে না। একহাতে গলার ফুটো বোজানোর চেষ্টা করে, অন্য হাতে গ্লাস নিয়ে ঢক করে কিছুটা পানীয় হামদি অবলীলায় শরীরের অন্দরমহলে চালান করে দিলেন। আমি ‘থ’ মেরে দাঁড়িয়ে সেই অলৌকিক দৃশ্যটি দেখেছিলাম।
উঠব উঠব করছি, গৌরকিশোরের হাতে হামদি একটি চিরকুট ধরিয়ে দিলেন। রোমান হরফে লেখা একটি বাংলা লাইন। “সারা জীবন ধরে তুমি খেলে সিগার আর আমার হল ক্যানসার?’
আজকালে হামদির নিঃশর্ত বশ্যতা স্বীকার করেছিলাম শুধু আমি। শিষ্য বলতে পারেন, চ্যালা বলতে পারেন, চামচা বললেও আমার কোনও আপত্তি নেই। আমাকেও অনবরত গুরুর গালাগাল আর মুখ-ঝামটা হজম করতে হয়েছে, আমি সে সব গায়ে মাখিনি। হামদি লিখতেন ইংরেজিতে। আমি ছাড়া অন্য কারও সেটা অনুবাদ করার অধিকার ছিল না। প্রাঞ্জল ভাষা, পণ্ডিতি দেখানোর অযথা চেষ্টা নেই। মাইনের দিন পকেটে নগদ এলেই হামদি ছুটতেন কাবুলিওয়ালার কাছে, সুদের মাসিক কিস্তি চোকাতে, সঙ্গী আমি। তারপর হামদির গন্তব্য ছিল ম্যাজেস্টিক বার, ম্যাডান স্ট্রিটে। পরের পর পানীয় শেষ করতে করতে একসময় হামদি গুনগুন করে সুর ভাঁজতেন, কীসের সুর তা বোঝার কোনও উপায় ছিল না। সবশেষে শরীর যখন আর নিতে পারছে না, হামদি বারের মাঝখানে টেবিলে মাথা রেখে নিশ্চিন্তে নিদ্রা যেতেন। তখন আমার কড়ি-বরগা গোনা ছাড়া আর কোনও কাজ থাকত না। হামদির এই রুটিনে ম্যাজেস্টিকের বেয়ারারা এতটাই অভ্যস্ত ছিলেন যে কেউ কোনোভাবে তাঁকে বিরক্ত করতেন না। ঘুম ভেঙে ওঠার পরে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি থাকত না, বেয়ারাদের মধ্যে কেউ হামদিকে কাঁধে করে দোতলা থেকে একতলায় নামিয়ে ট্যাক্সিতে তুলে দিতেন। বেশ কয়েকবার আমিও তাঁকে ট্যাক্সিতে করে গল্ফ ক্লাব রোডে পৌঁছে দিয়েছি।
এই আশ্চর্য মানুষটির হাতেই আমার সাংবাদিকতার প্রথম পাঠ। পাতায় কী ভাবে মার্জিন রেখে লিখতে হয়, স্লাগ দিতে হয়, কিংবা টেলিপ্রিন্টার থেকে খবর বাছতে হয়, ইনট্রো কী ভাবে লিখতে হয়, শিরোনাম দিতে হয় কী ভাবে, এ সব কিছুই আমি হামদির কাছে শিখেছিলাম। তবে আসল শিক্ষাটা হোত কাজের বাইরে গুরু-শিষ্যের একান্ত সংলাপের সময়। হেন বিষয় ছিল না যা হামদির অজানা ছিল, কৌতূহলী মনের রংটা ছিল রামধনুর, উপরি পাওনা হিসেবে বিচিত্র সব অভিজ্ঞতার রোমহর্ষক গল্প। হামদির কাছেই শুনেছি, নীরদ মজুমদার স্টেটসম্যানের সম্পাদকীয় লিখতেন দুপুরে বারে বসে ন্যাপকিনের ওপর। ঠিক সময় বেয়ারা এসে সেটা নিয়ে যেত, ফিরে আসত অফিসে টাইপ হওয়ার পরে। পানপাত্র হাতেই সেই কপির প্রুফ দেখে দিতেন নীরদবাবু। হামদির মুখে সাহেবি স্টেটসম্যানের নানাবিধ কেতার কথা শুনতে আমার খুব মজা লাগত। মনে হত যেন রূপকথার গল্প। মেজাজ শরিফ থাকলে হামদি বে-র সান্নিধ্য ছিল কলেজের ক্লাসের মতো। মাত্র বছর খানেকের মধ্যে হামদি আমাকে এমন ভাবে তৈরি করে দিয়েছিলেন যে গোটা বার্তা বিভাগ আমার দায়িত্বে তুলে গিতে গৌরকিশোরকে দ্বিতীয়বার ভাবতে হয়নি। আমার বয়স তখন পঁচিশ হব-হব।
হামদিকে কর্তৃপক্ষ রাখবে না আর হামদি না থাকলে তিনিও থাকবেন না, এটাই ছিল গৌরকিশোরের পণ। সেই অবস্থান থেকে কেউ তাঁকে টলাতে পারেনি। একদিন অফিসে গিয়ে দেখলাম সম্পাদকের গাড়ি লাহাবাড়ির প্রশস্ত আঙিনায় দাঁড়িয়ে আছে। সারথি জানালেন, রোজকার মতো সেই সকালেও তিনি গৌরকিশোরের বাড়ি গিয়েছিলেন তাঁকে অফিসে নিয়ে আসার জন্য। তাঁকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, সম্পাদক আর অফিসে আসবেন না। এক্কেবারে রইল ঝোলা, চলল ভোলা স্টাইলে নিজের স্বপ্ন-নীলয় থেকে নিঃশব্দে বিদায় নিলেন গৌরকিশোর, আমাদের কাউকে কিছু জানালেন না, বিদায়-ভাষণ দেওয়া বা একটা ফেয়ারওয়েল নোট রেখে যাওয়া তো দূরস্থান।
গৌরকিশোরের অকস্মাৎ প্রস্থান আমাকে নাড়িয়ে দিয়েছিল, মনে হচ্ছিল হঠাৎ নিজেকে কেমন যেন অনাথ লাগছে। তখনই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম যে গোকুলে কৃষ্ণার্জুনই থাকবে না আমি সেখানে কেন আর সময় নষ্ট করতে যাব? আমার চোখে সেটাই ছিল আজকালের মৃত্যুদিন। তারপরেও কাগজ অবশ্য বেরিয়েছে, এখনও বেরোচ্ছে, গৌরকিশোরের চিন্তা-ভাবনার ছিটেফোটাও সেখানে অবশিষ্ট নেই। সত্যজিৎ রায়ের ক্যালিগ্রাফি কাগজের মাস্তুলে রয়ে গিয়েছে যেন স্বপ্নভঙ্গের বিষাদমাখা স্মারক।
কী স্বপ্ন দেখেছিলেন গৌরকিশোর?
বাংলাভাষায় একটা ঝকঝকে আধুনিক সংবাদপত্র যা স্থানীয় রাজনীতির অন্ধগলিতে আটক না থেকে দ্রুত বদলাতে থাকা বিশ্বের বিশ্বাসযোগ্য প্রতিবিম্ব হয়ে উঠবে, গুরুত্ব পাবে বিদেশের ঘটনাবলি, প্রযুক্তির অপ্রতিরোধ্য অগ্রগতি, বিজ্ঞানের নিত্য-নতুন আবিষ্কার, পরিবেশ নষ্ট হওয়ার বিপদ, মাটির সঙ্গে লেপ্টে থাকা মানুষের কথা, তাদের সুখ, দুংখ, জীবন সংগ্রামের কাহিনি, মানবিক মূল্যবোধের স্পষ্ট অবক্ষয়। আনন্দবাজারের ঘরানায় দিনের পর দিন চর্বিত-চর্বণ করতে গিয়ে গৌরকিশোর হাঁফিয়ে উঠেছিলেন, কায়মনোবাক্যে চাইছিলেন একটু খোলা হাওয়া, সত্যের প্রতি নিষ্ঠ থেকে একটু অন্যরকম দৃষ্টিভঙ্গি, ভালোবাসা, আবেগ আর স্পর্ধা। খেলার নিয়ম বদলে দেওয়ার টেমপ্লেট হিসেবে আজকালকে গড়েপিটে তৈরি করতে চেয়েছিলেন। গৌরকিশোর নিজে যে তাঁর স্বপ্নের একটা স্পষ্ট রূপরেখা আমাদের সামনে রাখতে পেরেছিলেন তা নয়, দৈনন্দিন স্তরে তাঁর সাংবাদিকতার ধরণ দেখে আমি নিজের মতো করে এই উপসংহারে এসেছিলাম। আসলে ‘ট্রায়াল অ্যান্ড এরর’ পর্ব চুকে যাওয়ার আগেই তো সব শেষ হয়ে গিয়েছিল।
যেমন এক রাতে অফিসে পৌঁছতে আমার বেশ দেরি হয়েছিল, বীভৎস জ্যাম হয়েছিল শিয়ালদার কাছে। আমি কাগজের ইন চার্জ, সহকর্মীরা হাত গুটিয়ে বসে আছে, গৌরকিশোর নিজেই চলে এসেছিলেন নিউজ ডেস্কে। আমাকে দেখতে পেয়ে গম্ভীরভাবে দেরির কারণ জানতে চাইলেন। আমার ব্যাখ্যা শেষ হতে না হতেই বললেন, ‘খুব ভালো কথা, নিজের অভিজ্ঞতাটা এবার লিখে ফেল।’ লিখলাম, লেখাটা নিজেরই পছন্দ হল না, তবে হেডিংটা হল – ‘জ্যাম আর জ্যামের জটা/এই নিয়ে ক্যালকাটা। সুব্রত সেনগুপ্ত আমার কপিটা এডিট করে শিরোনামটি দিয়েছিলেন। আজকালে তখন সাহিত্যিক কর্মী বলতে সবেধন নীলমনি সুব্রতদা। সজ্জন, রসিক, স্বল্পবাক, শাস্ত্র-বিরোধী গল্পকার। পরের দিন আমার কপিটা প্রথম পাতায় ছাপা হয়েছিল।
শাস্ত্র-বিরোধী সাংবাদিকতা করার জন্য আরও দুই দিকপাল ছিলেন, তাঁরা চাকরি করতেন না, কিন্তু প্রায় রোজই লিখতেন। জ্যোতির্ময় দত্ত ও রাঘব বন্দ্যোপাধ্যায়। সম্পূর্ণ বিপরীত ঘরানার দুই লেখক, কলমের শক্তি আর বোধের গভীরতা সমতুল। জ্যোতিদার গদ্য ছিল ছন্দোময়, শব্দগুলো স্ফটিকের মতো জ্বলজ্বল করত। রাঘবদার স্টাইলটাই ছিল সহজ কথা জটিল করে দেখানো, কিন্তু অন্তর্ভেদী। আমি মজা করে বলতাম, বাংলা সাংবাদিকতার কমলকুমার। এই দু’জনের সঙ্গ, কালে কালে বন্ধুত্ব আমার জীবনে আজকালেরই দান।
এমন একটি পরীক্ষামূলক কাগজের জন্য প্রয়োজন ছিল তরুণ প্রাণের, যারা ঘণ্টার হিসেব কষে অফিসে আসবে না, গাধাকে লজ্জায় ফেলে দেওয়ার মতো পরিশ্রম করতে পারবে, আবেগ আর একাগ্রতাই হবে যাদের চালিকাশক্তি। আমরা সবাই বিনা বাক্যব্যয়ে সামান্য বেতনের বিনিময়ে ঠিক সেটাই করতাম। একদিনও ছুটি না নিয়ে আমি পরপর নব্বই দিন নাইট ডিউটি করেছি, শারীরিক ক্লেশ গ্রাহ্যের মধ্যে আনিনি। আমি একা নই আরও অনেকেই। অফিস বলতে চোখের সামনে যে ছবিটা ভেসে ওঠে সাবেক আজকাল তা ছিল না। প্রকাণ্ড লাহাবাড়ির প্রশস্ত খোলা চাতালটি ছিল ওই দালানের প্রধান আকর্ষণ। আমাদের যা কিছু খুনসুটি, বদমাইশি মায় বৌদ্ধিক চর্চারও জায়গা ছিল চাতালের গায়ে শ্বেত-পাথরের লম্বা সিঁড়ি। নাইট ডিউটির শেষে পূর্ণিমার রাতে জ্যোৎস্নায় ভেসে যেতে যেতে সেখানে বসে আমরা গলা ছেড়ে কোরাসে গানও গেয়েছি অনেক। অফিসকে আমরা বাড়িতে বদলে ফেলেছিলাম রাতারাতি।
আমাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন মেয়েও ছিল। একসঙ্গে অনেক মেয়েকে সাংবাদিকতা করার সুযোগ দিয়ে গৌরকিশোর সময়ের আগেই এক অনন্য নজির সৃষ্টি করেছিলেন। আশির দশকের গোড়াতে সাংবাদিকতা ছিল আপাদমস্তক পুরুষতন্ত্র, মেয়েদের দ্বারাও এই কাজটা সম্ভব সেই চেতনারই উন্মেষ হয়নি তখন, তাদের প্রবেশাধিকার দেওয়া তো দূরের কথা। অনেকটা সাবেক ইংল্যান্ডের প্রাচীন ক্লাবগুলির মতো, যাদের বাইরে সাইনবোর্ডে লেখা থাকত, ‘কুকুর আর মহিলাদের প্রবেশ নিষেধ।’ গৌরকিশোর সেই রক্ষণশীল পুরুষতন্ত্রের দুর্গে কামান দেগেছিলেন আজকাল দিয়ে। শিক্ষানবীশদের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশের বেশি ছিল মেয়ে। আমার প্রেসিডেন্সি কলেজের বন্ধু মৃত্তিকা মিত্র ছিল সেই দলে। সে আগে আজকাল ছেড়েছিল না আমি, এত যুগ পরে সেটা সঠিকভাবে মনে পড়ে না। তার বহু বছর পরে ফেসবুকে মৃত্তিকার একটি ছবি ও তলার ক্যাপশন দেখে বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল। ক্যানসার নিয়ে গেছে ওকে। অকালে।
ছেলেবেলার সহকর্মীদের মধ্যে অনেকেরই ছুটি হয়ে গিয়েছে অসময়ে। হয়ত সকলের খবরটাও আমার কাছে নেই। তাদের স্মৃতি রোমন্থন এখানে করছি না, চোখ বুজলেই আমি তাদের দেখতে পাই, তাদের উজ্জ্বল মুখগুলো মনে পড়ে, ভেসে আসে টুকরো টুকরো সুখস্মৃতি। সেটাই থাক সঞ্চয়ে। মৃত্যু ধ্রুব, জীবন তবুও ধ্রুবতারা।
চাকরি দেওয়ার আগে আমাদের বাছাই পর্বটি ছিল একেবারে যেন হার্ডল রেস, একটার পর একটা বেড়া টপকাচ্ছি, তবু গন্তব্য মনে হচ্ছে এখনও অনেক দূর। প্রথমে লিখিত পরীক্ষা তারপরে ডিসার্টেশন জমা দেওয়া তারপরে ভাইভা, সবশেষে ইন্টারভিউ। এত রকম কাণ্ডে সসম্মানে উত্তীর্ণ হওয়ার পরে বেতন মাসে ৬৫০ টাকা। আমার ডিসার্টেশনের বিষয় ছিল ‘এ সার্ভে অব ইন্ডিয়াজ মডার্নাইজেশন সিন্স ১৪২৯’, অনেক খেটেখুটে, বার কয়েক ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে গিয়ে পাঁচ হাজার শব্দ লিখেছিলাম। এমন বিচিত্র ও কঠিন প্রবেশিকা পর্ব তার আগে বা পরে ভূভারতে কোনো খবরের কাগজে ছিল না। চল্লিশ বছর পরে এখন সে কথা ভাবলে হাসি পায়, মনে হয়, অন্তর্বাসে বুক পকেট লাগানোর উদ্যোগ ছিল যেন। অচিরেই অবশ্য সুপারিশে নিয়োগ শুরু হয়েছিল, আমাদের ব্রাহ্মণত্বের কোনও গুরুত্বই আর রইল না।
গৌরকিশোরের স্বপ্ন এবং পরিকল্পনা দুটোই ছিল উচ্চমার্গের, বাজারে তা চলবে কিনা সে কথা কেউ ভেবে দেখেনি। ১৯৮১-র কথা না হয় বাদই দিলাম, আজও বাংলা সংবাদপত্রের বাজার এই ধরণের কাগজের জন্য তৈরি নয়। চল্লিশটা বছরের নিবিড় অভিজ্ঞতার সার কথা হল বাজারে যা খাবে তার বাইরে বাংলা সংবাদপত্র দৃষ্টি প্রসারিত করার চেষ্টাই করেনি। ভাষা, বিষয় নির্বাচন, উপস্থাপনা সবটাই তরলীকৃত, চটকদার। তাদের ভুবন অতি ক্ষুদ্র, স্থানিক অথবা আঞ্চলিক, শূন্যগর্ভ দলীয় রাজনীতি ও তার কুশীলবেরাই বাংলা কাগজের প্রাণ-ভোমরা। আমার স্থির বিশ্বাস আজকালে থেকে গেলে আরও দুঃখের দিন দেখতে হত গৌরকিশোরকে, কাগজের বাণিজ্যিক ব্যর্থতার ফল হত আরও মারাত্মক। সেদিন আসার আগেই আজকাল ছেড়ে চলে গিয়ে ভালোই করেছিলেন গৌরকিশোর। দাসত্বের সঙ্গে ব্যর্থতার গ্লানি তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি।
গৌরকিশোরের প্রস্থানের পরে আমিও আর বেশিদিন লাহাবাড়িতে থাকিনি। বাইশটি বছর সরকারদের ঘাটে নোঙর করার পরে, তরী নিয়ে ঘাটে ঘাটে ভেসে বেড়িয়েছি। সাংবাদিকতা বলতে আজকালে যা শেখার চেষ্টা করেছিলাম তার সবকিছু ভুলে গড্ডালিকা প্রবাহে নেমে পড়েছি, অংশ নিয়েছি ইঁদুর-দৌড়ে। তবু কর্মজীবনের গোড়ায় আজকালের ওই কয়েকটি মাস ছিল শ্রেষ্ঠ সময়, বড়ো আনন্দের, বড়ো রোমাঞ্চকর। স্বপ্নভঙ্গ হয়েছিল ঠিক, স্বপ্ন দেখতেও তো শিখেছিলাম!