logo

হারানো প্রেমের ছবি ফিরিয়ে দিল এআই

  • August 16th, 2022
Man-Woman

হারানো প্রেমের ছবি ফিরিয়ে দিল এআই

নিজস্ব প্রতিবেদন: বছর তিনেক আগে এক্স-রে নজরে ধরা পড়েছিল ছবির নীচে লুকোনো ছবি। পুরোনো প্রেমিকা? প্রশ্নটা ফের উস্কে দিয়েছে দুই বিজ্ঞানীর কাজ। আড়ালে থাকা সেই অবয়ব তুলে এনেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। আলোচনার কেন্দ্রে ইটালিয়ান শিল্পী আমেডেও মোডিলিয়ানির আঁকা বিখ্যাত ছবি 'পোর্ট্রেট অফ আ গার্ল'।

১৯১৭ সালে আঁকা এই মাস্টারপিস ছিল লন্ডনের টেট গ্যালারির জিম্মায়। সাদা চোখে এক নারীর দীর্ঘায়িত অবয়ব, যা মোডিলিয়ানির সিগনেচার স্টাইল। কিন্তু ২০১৮ সালে এক আশ্চর্য বিষয় নজরে আসে গ্যালারির সংরক্ষকদের। আবছা কিছু রেখায় ছবির আড়ালে থাকা এক চেহারার আভাস ফুটে ওঠে এক্স-রেতে। বোঝা যায়, অন্য এক নারীর প্রতিকৃতির ওপর দিয়ে তুলি চালিয়েছিলেন শিল্পী। কে সেই মুছে যাওয়া মেয়ে?
গ্যালারির তৎকালীন কিউরেটর ন্যান্সি ইরসনের অনুমান ছিল, ছবির পুরোভূমিতে থাকা নারীর পিছনে যিনি লুকিয়ে আছেন, তিনি আর কেউ নন, ইটালিয়ান শিল্পীর পুরোনো প্রেমিকা বিয়াত্রিচে হেস্টিংস। এই ছবি আঁকার ঠিক এক বছর আগে যাঁর সঙ্গে দু'বছরের ঝোড়ো সম্পর্ক ভেঙে বেরিয়ে এসেছিলেন মোডিলিয়ানি।

১৯১৪ সালে বয়সে পাঁচ বছরের বড় বিয়াত্রিচে হেস্টিংসের প্রেমে পড়েন আমেডেও মোডিলিয়ানি। ইটালিয়ান তরুণের পায়ের নীচে জমিটা তখনও তেমন শক্ত হয়নি। অন্য দিকে লন্ডনে জন্মানো দক্ষিণ আফ্রিকান বিয়াত্রিচে লেখক ও সাংবাদিক হিসেবে নাম করেছেন। কবিতা আর বইপড়া ছিল দু'জনেরই নেশা। বৌদ্ধিক আবেদনের টানে পরস্পরের কাছে এসেছিলেন তাঁরা। মোডিলিয়ানির আঁকার ধরনকেও দৃশ্যত প্রভাবিত করেন বিয়াত্রিচে।

তাঁদের সম্পর্ক ছিল যেমন নিবিড়, তেমনই উদ্দাম। অপরিমিত মদ্যপান, ড্রাগের নেশা, অশান্তি, এমনকী মারামারি ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। ১৯১৬ সালে শেষ পর্যন্ত সম্পর্কটা ভেঙে যায়। মোডিলিয়ানি পরে শিল্পী হিসেবে খ্যাতি পেলেও ১৯২০ সালে মাত্র ৩৫ বছর বয়সে টিউবারকিউলার মেনিনজাইটিসে মৃত্যুর সময় তাঁর সঙ্গী ছিল দারিদ্র। আর তাঁর জীবনের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ প্রেম বিয়াত্রিচে আত্মহত্যা করেন ১৯৪৩ সালে।

হেস্টিংসের সঙ্গে সম্পর্ক ভাঙার পরেই সম্ভবত প্রেয়সীর ছবি মুছে ফেলতে চেয়েছিলেন মোডিলিয়ানি। হারিয়ে যাওয়া সেই প্রতিকৃতি উদ্ধার করেছেন ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের দুই বিজ্ঞানী। এক্স-রে নজরে ধরা পড়া আবছা চেহারা আর সাধারণ ভাবে মোডিলিয়ানির কাজ সম্পর্কে বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণকে কাজে লাগিয়ে তাঁরা এমন এক অ্যালগোরিদম তৈরি করেছেন, যা ছবির আপাত দৃশ্যের অন্তরালে নজর চালিয়ে তার 'গোপন কথা'টি ফাঁস করে দিয়েছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কাজে লাগিয়ে 'হারানো' শিল্প খুঁজে বার করার উদ্যোগ নিয়েছে অক্সিয়া প্যালাস সংস্থা। 'নিওমাস্টার্স' নামে এই প্রকল্পেরই নেতৃত্বে রয়েছেন ওই দু'জন, স্নায়ুবিজ্ঞানী অ্যান্টনি বুরেচ এবং পদার্থবিদ জর্জ কান।

দুই বিজ্ঞানীর দাবি, তাঁদের কাজ শুধু যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে কী করা সম্ভব তার প্রমাণ দেবে, তা নয়। শিল্পকলাকে দেখা ও বোঝার ধারণাটাও বদলে দেবে। কারণ, শুধুমাত্র মোডিলিয়ানির ছবি নয়, আগামী কয়েক বছরে এমন আরও অনেক লুকিয়ে থাকা ছবি খুঁজে বার করবেন তাঁরা। একই ক্যানভাসে একাধিক ছবি আঁকাটা শিল্পী মহলে ব্যতিক্রমী কিছু নয়। কখনও তার কারণ ছিল দারিদ্র, নতুন ক্যানভাস জোগাড় করতে না পারা। কখনও বা শিল্পীর খুঁতখুঁতানি, নিজেরই আঁকা ছবি নিয়ে সন্তুষ্ট হতে না পারা। সেই সব চাপা পড়ে যাওয়া ছবি এ বার চোখের সামনে আসবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বাহাদুরিতে।

কিন্তু আজ যদি বেঁচে থাকতেন মোডিলিয়ানি, বিজ্ঞানের এই কেরামতি দেখে কী প্রতিক্রিয়া হত তাঁর? যে যন্ত্রণার স্মৃতি তিনি মুছে ফেলতে চেয়েছিলেন রঙের প্রলেপে, তা নতুন করে সামনে আসা কি মেনে নিতে পারতেন? প্রশ্নগুলো মাথায় এসেছিল দুই বিজ্ঞানীরও। কিন্তু বুরেচের যুক্তি, কোনও মানুষ তাঁর সম্পর্কে যা সকলকে জানাতে চান, ইতিহাস শুধু সেটুকুই জেনে সন্তুষ্ট হয় না। নতুন নতুন তথ্যের অনুসন্ধান করে অতীতের এক বিশ্বাসযোগ্য দলিল তৈরি করাই তার কাজ।

মোডিলিয়ানির ছবিতে 'লুকোনো' প্রতিকৃতিটি আপাতত প্রদর্শিত হচ্ছে ইস্ট লন্ডনের লেবেনসন গ্যালারিতে। যদিও সবাই যে একবাক্যে ছবির মানুষটিকে বিয়াত্রিচে হেস্টিংস বলে মেনে নিচ্ছেন, তা নয়। যেমন, বিশেষজ্ঞ কেনেথ ওয়েন। মোডিলিয়ানির কাজ নিয়ে দীর্ঘদিন চর্চা করা ওয়েনের বক্তব্য, ১৯১৪ থেকে ১৯১৬ সাল, অর্থাৎ যে সময়টায় আমেডেও এবং বিয়াত্রিচে একটি সম্পর্কে ছিলেন, তার মধ্যে প্রেমিকার বহু ছবি এঁকেছেন শিল্পী। তার মধ্যে রয়েছে তেলরঙে আঁকা ১৪টি প্রতিকৃতি এবং অগুনতি স্কেচ। আর সেই ছবিগুলোর আদলে কোনও মিল নেই। নানা ভাবে মনের মানুষকে ফুটিয়ে তুলেছেন শিল্পী। কখনও তাঁর মুখের আদল লম্বাটে, কখনও বা গোলাকার। আসলে ঠিক ওই সময়টাতেই মোডিলিয়ানির নিজস্ব স্টাইলের বিকাশ ঘটছিল―লম্বাটে মুখ ও গ্রীবা, আফ্রিকান শৈলীর ছাপ। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে উদ্ধার হওয়া ছবিটিতে সেই লক্ষণগুলো থাকলেও তা নির্ভুল ভাবে বিয়াত্রিচেকে চিনে নেওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *