- August 16th, 2022
মার্কিন সেনা সরছে, ভাগ্যই ভরসা আফগান দোভাষীদের
নিজস্ব প্রতিবেদন: বাড়ির কাছেই পড়ে ছিল ছোট ভাইয়ের মুণ্ডহীন দেহটা। সঙ্গে চিরকুট: কাফেরদের সঙ্গে আর কখনও কাজ কোরো না।
তার ঠিক ১২ দিন আগের ঘটনা। ২০০৯ সালের সেই দিনটা যেন চোখের সামনে দেখতে পান আমিন। যিনি আজও তাঁর আসল নাম প্রকাশ করতে ভয় পান। প্রাণের ভয়। তালিবানদের আতঙ্কে মাসের পর মাস পালিয়ে পালিয়ে বেড়ানোর পর সবে কয়েকদিন হলো কাবুল থেকে গ্রামের বাড়িতে ফিরেছিলেন খোস্ত প্রদেশের এই যুবক। পারিবারিক চাষবাসের কাজে ছোট ভাইকে সাহায্য করবেন বলে ঠিক করেছিলেন। গ্রীষ্ম শুরুর সেই দিনটায় মাঠের ধারে বসে দুই ভাই সে ব্যাপারেই আলোচনা করছিলেন। আর সবুজ ঘাসের ওপর খেলে বেড়াচ্ছিল বাড়ির খুদেরা।
গ্রামজীবনের সাদামাটা ছবিটা হঠাৎই চুরমার হয়ে গেল গাড়ির ব্রেক কষার শব্দে। তারপর এলোপাথাড়ি গুলি। ছোটদের কোনওমতে টেনে হিঁচড়ে ঘরে ঢুকিয়ে আমিন যতক্ষণে ছুটে গিয়ে বন্দুকটা নিয়ে এলেন, ততক্ষণে তাঁর ভাইকে তুলে নিয়ে গিয়েছে তালিবানরা।
পরের কয়েক দিনে গ্রামবাসীদের সাহায্য নিয়ে বার বার তিনি তালিবানদের বোঝানোর চেষ্টা করেছেন যে, ২০০৪ থেকে ২০০৭ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত মার্কিন সেনাদের জন্য দোভাষীর কাজ করলেও, সে কাজ তিনি ছেড়ে দিয়েছেন অনেকদিন। এখন আর তাদের সঙ্গে তাঁর কোনও সম্পর্ক নেই। কিন্তু শত অনুনয় বিনয়েও কাজ হয়নি। 'কাফের'দের সঙ্গে কাজ করার জন্য আমিনকে 'দৃষ্টান্তমূলক' শাস্তি দিতে তখন একবগ্গা তালিবানরা।
মার্কিন সেনা আফগানিস্তান ছাড়ছে। এ বছরের সেপ্টেম্বরের আগেই সেনা সরানোর প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার কথা। তারপর এমন 'শাস্তি' আরও কতজনের ভাগ্যে লেখা আছে, তা ভেবেই কাঁটা আমিনের মতো কয়েক হাজার মানুষ। যাঁদের কারও বয়স ত্রিশের কোঠায়, কারও বা চল্লিশ পেরিয়েছে। মার্কিন সেনার সঙ্গে এক সময় কাজ করেছিলেন। কেউ দোভাষী হিসেবে, কেউ নির্মাণকর্মী হিসেবে, কেউ বা অন্য কোনও ভূমিকায়। আজ সেটাই কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। তালিবানদের সহজ নিশানা তাঁরা। এক সময়ের সহযোগীদের বিপদে ফেলে রেখেই পাততাড়ি গুটোচ্ছে আমেরিকা। আমিনের মতো বহু মানুষ আজ 'প্রতারিত'।
২০০৯ সালেই মার্কিন সেনার দোভাষী হিসেবে কাজ শুরু করেন জামিল। আমিনের মতো তিনিও নিজের আসল পরিচয় দিতে সাহস পান না। কিন্তু ১০-১২ বছর আগের সেই দিনগুলোর কথা ভোলেননি। শুধু অল্পস্বল্প ইংরেজি জ্ঞানের জোরে মোটা মাইনের কাজ জোগাড় করতে পেরে তখন আহ্লাদে আটখানা সদ্য উনিশের তরুণ।
পাছে তালিবানদের কোপের মুখে পড়তে হয়, তাই 'চাকরি'র কথা গোপন রেখেছিলেন। এমনকি বাড়ির লোকেরাও জানতেন না মার্কিন সেনার সঙ্গে তাঁর যোগাযোগের কথা। ২০১০ সালের শেষ দিকের একদিন। নুরিস্তান প্রদেশের পাইন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল সেনা কনভয়। গাড়িতে বসে জামিল ভাবছিলেন মাত্র এক সপ্তাহ আগে গ্রেনেডের ঘায়ে প্রাণ হারানো এক বন্ধুর কথা। হঠাৎ প্রচণ্ড শব্দ। কেঁপে উঠল গাড়িটা। সবাই হুড়মুড়িয়ে নেমে আড়াল খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করলেন। শেষ পর্যন্ত প্রাণে বাঁচলেও, জামিলের ডান পায়ে ছিটকে এসে লাগল গ্রেনেডের টুকরো, আর বাঁ পায়ে গুলি।
নড়াচড়ার ক্ষমতা হারিয়ে মাঠের মধ্যে পড়ে থাকা জামিলকে উদ্ধার করে তাঁর সহকর্মীরাই সেনা শিবিরে ফিরিয়ে নিয়ে যান। প্রায় চার মাস ধরে চিকিৎসা চলে। ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে সে সময় বাড়ির সঙ্গে কোনও রকম যোগাযোগের চেষ্টা করেননি জামিল। শেষ পর্যন্ত নিজের পায়ে ফের উঠে দাঁড়ালেন। তার পরেও মার্কিন সেনার সঙ্গে একাধিক অভিযানে গিয়েছেন।
কিন্তু ২০১১ সালের নভেম্বরে মাথায় আকাশ ভাঙল। হঠাৎই একদিন জামিল ও তাঁর দুই আফগান সহকর্মীকে বলা হলো, অবিলম্বে শিবির ছাড়তে হবে। কারণ, তাঁরা নাকি মার্কিন সেনার কাছে আর 'বিশ্বাসযোগ্য' নন। কেন এই সিদ্ধান্ত, আজও তা জানেন না জামিল। নির্দেশ যখন এসেছিল, রাত তখন তিনটে। দিনের আলো ফোটা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে চেয়েছিলেন জামিলরা। সেটুকু সুযোগও দেওয়া হয়নি।
সে সময় দিনের পর দিন লুকিয়ে থেকেছেন। ফোনে রোজ মেরে ফেলার হুমকি আসত অচেনা নম্বর থেকে। আত্মগোপন করে থাকায় কাজের চেষ্টাও অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। অবশেষে ২০১২ সালে দেশ ছেড়ে পালানোর সিদ্ধান্ত নেন জামিল। সীমান্ত পেরিয়ে প্রথমে ইরান, তারপর তুরস্ক, গ্রিস, ডেনমার্ক হয়ে সোজা নরওয়ে। সেখানেই ছিলেন পরের চার বছর। একটা ভালো চাকরিও জোগাড় করেছিলেন। আশা ছিল, শরণার্থী হিসেবে অসলোতেই থেকে যাবেন। কিন্তু তাঁর আবেদন খারিজ হয়ে যায়। ২০১৬ সালে আফগানিস্তানে ফিরতে বাধ্য হন জামিল। কাবুলের একটি ভাষাশিক্ষা কেন্দ্রে এখন ইংরেজি পড়ান আর প্রতিদিন বাঁচেন যে কোনও মুহূর্তে খুন হওয়ার একরাশ ভয় আর কোনওক্রমে রেহাই পেয়ে যাওয়ার এক চিলতে আশা নিয়ে।
শুধু আমিন কিংবা জামিল নন, আফগানিস্তানে মার্কিন সেনা মোতায়েন থাকার সময়ে যাঁরা আঠেরোর গণ্ডি পেরিয়েছেন, তাঁদের কাছে সেনার দোভাষী হওয়া ছিল একটা আকর্ষক পেশা। অন্য কোনো যোগ্যতা নয়, শুধুমাত্র ইংরেজিতে কথাবার্তা চালানোয় মোটামুটি সাবলীল হলেই কাজ মিলত। আর কাজে ঝুঁকি থাকলেও মাইনে ছিল গড়পড়তার অনেক বেশি। কিন্তু এক সময় যা তাঁদের বা তাঁদের পরিবারকে বাঁচিয়ে রেখেছে, সচ্ছল জীবনের স্বাদ এনে দিয়েছে, আজ তারই জন্য তাঁদের মাথায় ঝুলছে তালিবানি প্রতিশোধের খাঁড়া। যে কোনও মুহূর্তে মরতে হবে, এই ভয়ে দিন কাটাচ্ছেন আমিন, জামিলদের মতো হাজার হাজার মানুষ। কেউ ছদ্মনামে পরিবারের থেকে দূরে কোথাও লুকিয়ে আছেন, কেউ বা পুরো পরিবার নিয়েই শহর থেকে শহরে ঠিকানা বদল করে চলেছেন নিরাপত্তার খোঁজে।
স্থানীয়দের সাহায্য নিতে গিয়ে আসলে যে তাদের বিপদে ফেলা হয়েছে, আমেরিকার তা অজানা নয়। মার্কিন সেনার দোভাষী হিসেবে কাজ করা আফগান ও ইরাকিদের যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসের সুযোগ করে দিতে ২০০৬ সালে বিশেষ অভিবাসী ভিসা (এসআইভি) চালু করে মার্কিন সরকার। পরে দোভাষী ছাড়া অন্য ভূমিকায় যাঁরা আফগানিস্তান বা ইরাকে মার্কিন সেনাকে সাহায্য করেছিলেন, তাঁদের সকলকেই এই ভিসার আওতায় আনা হয়। গত বছরের মাঝামাঝি পর্যন্ত ১৮ হাজারের উপর আফগান এই ভিসার সাহায্যে সপরিবারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে গিয়েছেন। কিন্তু ব্রাউন ইউনিভার্সিটির 'কস্ট অফ ওয়ার' প্রজেক্ট চলতি বছরের এপ্রিলে যে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে, তাতে দাবি, এসআইভি প্রক্রিয়া অত্যন্ত জটিল এবং সময়সাপেক্ষ। একে তো ভিসা পেতে গড়ে অন্তত দু'বছর সময় লাগছে। তার ওপর দীর্ঘ প্রক্রিয়ার শেষে অনেকেরই আবেদন খারিজ হয়ে যাচ্ছে সামান্য কারণে।
সেই ২০১৬ সালে দেশে ফিরেই এসআইভির আবেদন করেছিলেন জামিল। আবেদন বাতিলের খবর আসতে চার বছর লেগে গিয়েছে। এ বছর ফের আবেদন করেছেন এক মার্কিন সেনাকর্মীর সুপারিশ-সহ। ভিসা পাওয়ার শর্ত হলো মার্কিন সেনার সঙ্গে অন্তত দু'বছর বিশ্বস্ত ভাবে কাজ করে থাকতে হবে। চব্বিশ মাস পূর্ণ হয়নি বলে ভিসা পাননি অনেকেই।
উরউজগানের আমানুল্লাহ যেমন। বছর খানেক মার্কিন সেনার হয়ে কাজ করার পরেই জানতে পারেন, ওই অঞ্চল থেকে সেনা সরে যাচ্ছে, তাই তাঁকে আর প্রয়োজন হবে না। এখন তাঁর প্রশ্ন: তালিবানদের যদি বলি, আমি মাত্র এক বছর কাজ করেছিলাম, তাই আমাকে মেরো না, ওরা কি আমাকে ছেড়ে দেবে? পরিবার নিয়ে কান্দাহারে লুকিয়ে আছেন তিনি। কাবুলে আত্মগোপন করে থাকা জবিউল্লাহ জায়াহ ২৩ মাস কাজ করেছিলেন মার্কিন সেনার সঙ্গে। তাঁর ক্ষেত্রে আবেদন খারিজের কারণ দেখানো হয়েছে 'সিকিউরিটি ইনএলিজিবিলিটি'। মার্কিন সেনার সঙ্গে মাঠঘাট ভেঙেছেন, বিস্ফোরণে আহত হয়েছেন, তার পরেও কী করে তাঁর বিশ্বস্ততা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে, সেটাই মাথায় ঢুকছে না জবিউল্লাহর।
ভিসার অপেক্ষায় থাকতে থাকতেই অনেকে তালিবানদের শিকার হয়েছেন। বাকিরা চরম অনিশ্চয়তার মুখোমুখি। মার্কিন প্রশাসন আশ্বাস দিয়েছে, যে সব আফগান তাদের সাহায্য করেছিল, তাদের সবাইকে দ্রুত আমেরিকায় স্থানান্তরের সুযোগ করে দেওয়া হবে। কিন্তু তার কোনও নির্দিষ্ট সময়সীমা জানাতে পারেনি। সেপ্টেম্বরের আগে সে কাজ শেষ হওয়া যে সম্ভব নয়, তা স্পষ্ট।
এদিকে গত সপ্তাহে তালিবানরাও বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছে, অতীতে যারা বিদেশি শক্তির হয়ে কাজ করেছে, তারা যদি সে কাজের জন্য অনুতপ্ত হয় এবং ভবিষ্যতে এমন ইসলামদ্রোহী কাজ আর করবে না বলে কথা দেয়, তাহলে তাদের কোনও ক্ষতি করা হবে না। কিন্তু তালিবানি হালচাল সম্পর্কে অভিজ্ঞ আফগানরা এই 'প্রতিশ্রুতি'তে আদৌ ভরসা রাখছেন না। তাঁরা জানেন, মার্কিন সেনা সরার পর সুতোয় ঝুলবে জীবন।


Arts and Literature
Bioscope
Columns
Green Field
Health World
Interviews
Investigation
Live Life King Size
Man-Woman
Memoir
Mind Matters
News
No Harm Knowing
Personal History
Real Simple
Save to Live
Suman Nama
Today in History
Translation
Trivia
Who Why What How

