logo

কে বড়, আয়োজক না খেলোয়াড়

  • August 16th, 2022
Green Field

কে বড়, আয়োজক না খেলোয়াড়

নিজস্ব প্রতিবেদন: সাংবাদিক বৈঠকে অংশ না নেওয়া নিয়ে আয়োজদের সঙ্গে ঝামেলার জেরে ফ্রেঞ্চ ওপেন টুর্নামেন্ট থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন নাওমি ওসাকা। কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন নিজের মানসিক স্বাস্থ্যরক্ষার কথা। বিশ্বের দু’নম্বর খেলোয়াড় এ ভাবে সরে দাঁড়ানোর পর শুধু টেনিস নয়, বিতর্কে সরগরম তামাম ক্রীড়াজগৎ। টেনিস কোর্টে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী সেরেনা উইলিয়ামস তো বটেই, নাওমির পাশে দাঁড়িয়েছেন মাইকেল ফেল্পস থেকে লিউইস হ্যামিল্টন। এই গোটা ঘটনায় দুটো জিনিস স্পষ্ট, ক্রীড়াকর্তা–খেলোয়াড় সম্পর্কের বদলে যাওয়া সমীকরণ এবং খেলার দুনিয়ায় এখনও মানসিক স্বাস্থ্যের উপেক্ষিত থাকা।

ওসাকা দুনিয়ার মধ্যে সর্বোচ্চ উপার্জনকারী অ্যাথলিট। যদিও ফ্রেঞ্চ ওপেনে তাঁর রেকর্ড ততো ভালো নয়। এর আগে কোনও বারই তৃতীয় রাউন্ডের গণ্ডি পেরোননি। এ বার প্রথম রাউন্ডে জিতলেও খেলোয়াড়দের জন্য বাধ্যতামূলক সাংবাদিক বৈঠকে হাজির হননি। সোশ্যাল মিডিয়ায় জানিয়েছিলেন, মানসিক স্বাস্থ্যরক্ষায় এই সিদ্ধান্ত। এর জেরে ১৫ হাজার ডলার ফাইন চাপিয়েই ক্ষান্ত হননি টুর্নামেন্টের কর্তারা, নাওমিকে উচিত শিক্ষা দিতে চারটি গ্র্যান্ড স্লাম টুর্নামেন্টের মাথারা একজোট হয়ে হুঁশিয়ারি দেন, সাসপেন্ড করা হতে পারে জাপানি টেনিস তারকাকে। শেষ পর্যন্ত সরে দাঁড়ান নাওমি। ফের সোশ্যাল মিডিয়াতেই নিজের সিদ্ধান্তের ব্যাখ্যা দিয়ে জানান, ২০১৮ সালের ইউএস ওপেনের পর থেকেই তিনি উদ্বেগ ও অবসাদজনিত সমস্যায় ভুগছিলেন।

অ্যাথলেটিক্স দুনিয়ায় খেলোয়াড়রা যে আর ক্রীড়াকর্তাদের কথায় ওঠাবসা করতে রাজি নন, সেটা পরিষ্কার হয়ে গেছে এই ঘটনায়। খেলায় আয়োজকদের গুরুত্ব বেশি হওয়া উচিত, নাকি যাঁরা আদতে মাঠে নেমে খেলেন তাঁদের, এই পুরোনো প্রশ্নটাও নতুন করে আলোচিত হচ্ছে। আজকের দিনে, যেখানে সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে সরাসরি লক্ষ লক্ষ অনুরাগীর পৌঁছে যাওয়াটা সহজ, সেখানে একদিকে যেমন খেলোয়াড়রা আর সংগঠক বা কর্মকর্তাদের চোখরাঙানিকে ভয় করছেন না, তেমনই জনসংযোগের জন্য গতানুগতিক সংবাদমাধ্যমের ওপর নির্ভর করার দায়ও তাঁদের নেই।

ক্রীড়াপ্রশাসকরা এই বদলটা এখনও মানতে পারছেন না। সাংবাদিক বৈঠকে কোনও খেলোয়াড়ের অনুপস্থিত থাকা বা তার জেরে জরিমানা নতুন ঘটনা নয়। কিন্তু নাওমির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নামে নিজেদের ছড়ি ঘোরানোর অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে কর্মকর্তারা এ বার বাড়াবাড়ি করে ফেলেছেন। ২৩ বছরের জাপানি খেলোয়াড় নিজের অবসাদে ভোগার কথা খোলাখুলি স্বীকার করার পর এখন তাঁরা রীতিমতো বেকায়দায়। সেই সঙ্গে যে প্রশ্নটা এই মুহূর্তে খেলাধুলার সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে যুক্ত মানুষজনকে ভাবাচ্ছে তা হল, খেলোয়াড়দের মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি ঠিক কতটা গুরুত্ব পায়?

সাংবাদিক বৈঠক এড়ানোর পর প্রথম পোস্টে নাওমি লিখেছিলেন, ‘আমার প্রায়ই মনে হয়, অ্যাথলিটদের মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টা কেউ মনে রাখে না… আমরা (সাংবাদিক বৈঠকে) বসে থাকি, হাজার বার উত্তর দেওয়া প্রশ্নের আবার উত্তর দিই, বা এমন কোনও প্রশ্নের মুখোমুখি হই যা নিজের ওপরেই সন্দেহ জাগিয়ে দেয়।’ সচরাচর সাংবাদিক বৈঠকে দু-চারটে খোঁচা মারা প্রশ্ন হলেও বেশিরভাগই থাকে মামুলি প্রশ্ন। তা সত্ত্বেও একজন খেলোয়াড় যখন সেই পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে অস্বস্তি বোধ করছেন, তখন সংগঠকদের উচিত ছিল সমস্যাটা বুঝে তাঁর পাশে দাঁড়ানো এবং একটা মধ্যপন্থী সমাধান খোঁজার চেষ্টা করা। তার বদলে খেলোয়াড়কে সবক শেখাতে গিয়ে যে নজির তাঁরা রাখলেন সেটা প্রশাসনিক এবং কৌশলগত দিক থেকে একটা চূড়ান্ত ব্যর্থতার নিদর্শন।

অত্যধিক প্রত্যাশার চাপ এবং সারাক্ষণ প্রচারের আলোয়, সংবাদমাধ্যমের নজরবন্দি হয়ে থাকা অল্পবয়সী খেলোয়াড়রা অনেক সময়েই উদ্বেগ, অবসাদের মতো সমস্যার মুখোমুখি হন। তাঁদের মধ্যে অনেকেই যে সামাজিক বাধা কাটিয়ে সেই সব সমস্যার কথা প্রকাশ্যে আলোচনা করতে পারছেন, সেটা নিঃসন্দেহে ভালো দিক। কিন্তু সমাজের কাছে, ক্রীড়া সংগঠকদের কাছে, সংবাদমাধ্যমের কাছে যে সংবেদনশীলতা তাঁরা আশা করেন, তা পান কি? যখন কোনও খেলোয়াড়ের মনে হয় সংগঠক, কর্মকর্তা এবং সংবাদমাধ্যমের আচরণ তাঁর মানসিক সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে, তখন ঠিক কী করা উচিত?

এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজা জরুরি। আর এখানে আরও যে প্রসঙ্গটা উঠে আসছে, তা হল চোরা বর্ণবিদ্বেষ। অশ্বেতাঙ্গ খেলোয়াড়দের প্রতি কোনও কোনও ক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যম একটু বেশিই আক্রমণাত্মক, এই অভিযোগ পুরোনো। ভেনাস ও সেরেনা উইলিয়ামসের ক্ষেত্রে এ প্রশ্ন বারবার উঠেছে। হাইতিয়ান-জাপানি নাওমি এ নিয়ে কোনও মন্তব্য করেননি ঠিকই, কিন্তু পোস্টের সঙ্গে সেরেনা উইলিয়ামসের একটি সাক্ষাৎকারের ভিডিয়ো পোস্ট করেছেন। ১৯৯৫ সালের ওই সাক্ষাৎকারে এক সাংবাদিক বার বার সেরেনাকে তাঁর ‘অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস’ নিয়ে প্রশ্ন করায় সেরেনার বাবা রিচার্ড তীব্র প্রতিবাদ করে ওঠেন। অশ্বেতাঙ্গ খেলোয়াড়রা প্রায়শই ভুল ধারণা বা বৈষম্যের শিকার হন, এই বিশ্বাস থেকেই হয়তো বর্তমান প্রজন্মের খেলোয়াড়রা আর তাঁদের কথা বলার জন্য সংবাদমাধ্যমের ওপর ভরসা রাখছেন না। জনসংযোগের নতুন মাধ্যমগুলিকে কাজে লাগিয়ে নিজেই নিজের কণ্ঠস্বর হয়ে উঠতে চাইছেন।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *