logo

সেতু যখন ভূতগ্রস্ত

  • August 16th, 2022
Trivia

সেতু যখন ভূতগ্রস্ত

নিজস্ব প্রতিবেদন: প্রত্যেকটা শহরের একটা নিজস্ব শাব্দিক মানচিত্র থাকে।আমাদের কোলকাতারই ধরুন না! পার্কস্ট্রিটের শব্দ আর গড়িয়াহাট মোড়ের শব্দ এক নয়, যেমন নয় বাগবাজার ঘাট আর নিউ আলিপুরের শব্দও। কিন্তু ধরুন আপাত নিরিবিলি নিঃশব্দ কোনও অঞ্চল যদি হঠাৎ সরগরম হয়ে ওঠে অশ্রুতপূর্ব কোনও আওয়াজে? আর সেই আওয়াজের উৎস যদি ব্যাখ্যাতীত হয়? 

না, ভূতের গল্প-টল্প ফাঁদতে বসিনি আমি। এরকম ঘটনা সত্যিই ঘটছে, ঘটে চলেছে প্রায় বছরখানেক ধরে, সানফ্রান্সিসকোর বিখ্যাত গোল্ডেন গেট ব্রিজে। উতল হাওয়া বইলেই একটা অদ্ভুত গুনগুনানি শুরু হয় এই ব্রিজ ঘিরে, শোনা যায় অনেক দূর অবধি। কতিপয় ভক্তের কানে স্নিগ্ধ মনে হলেও, অনেক মানুষ এই শব্দকে ‘অসহনীয়’ ও ‘ভৌতিক’ আখ্যা দিয়েছেন। জনৈক ভদ্রমহিলা একে গ্রহান্তরের আওয়াজ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এক স্থানীয় অধিবাসী সোশ্যাল মিডিয়ায় ক্ষোভ উগড়ে দিয়ে লিখেছেন, সংশোধনাগারে পুলিশের অত্যাচারে কয়েদিদের যে আর্তনাদ, তার সঙ্গে তুলনীয় এই আওয়াজটি। কেউ এ শব্দকে ভূতেদের গান বলেছেন, কারও কানে ভিক্ষু সন্ন্যাসীর সুগম্ভীর মন্ত্রোচ্চারণ কিম্বা শ্বাসবাদ্যের তীক্ষ্ণ ঝঙ্কার বলে মনে হয়েছে। যে সব পাঠকের শ্রবণ-অনুভূতিতে এখনও ধরা পড়ছে না শব্দটা, বব ডিলানের লেখা ‘অল অ্যালঙ দ্য ওয়াচ-টাওয়ার’ গানটা শুনবেন দয়া করে। গানের শেষ লাইনটা যখন গেয়ে উঠছেন জিমি হেন্ড্রিক্স, ‘অ্যান্ড দ্য উইন্ড বিগ্যান টু হাউল, হেই, অল অ্যালঙ দ্য ওয়াচ-টাওয়ার’ (And the wind began to howl,hey, all along the watch tower), বারবার গাইছেন, হারমোনিকায় অনুরণিত বাতাসের গর্জন ডুবিয়ে দিচ্ছে শব্দগুলোকে, গোল্ডেন গেট ব্রিজের ওই অদ্ভুত আওয়াজ কিছুটা হলেও ধ্বনিত হতে শুনবেন নিজের ভিতরে!

যে সব দিনে বাতাস বয় এতোলবেতোল, রহস্যময় গোঙানির মতো এ আওয়াজ স্থানীয় বাসিন্দাদের জীবন অতিষ্ঠ করে তোলে। সানফ্রান্সিসকোর শব্দ-মানচিত্রের উল্লেখযোগ্য অংশ, শহরের আলোচনার অন্যতম আলোচ্য বিষয়, হয়ে উঠেছে এই শব্দ। শখের গোয়েন্দারা চড়াই-উৎরাই বেয়ে শহর ছানবিন করে ফেলছে তার উৎস সন্ধানে। জনৈক সঙ্গীত পরিচালক বৈদ্যুতিন মাধ্যম ব্যবহার করে এই শব্দের অনুকরণে এক সুর সৃষ্টি করে, নিজেই ত্রাস-উদ্দীপক বলে অভিহিত করেছেন তাকে। প্রশাসনের তরফ থেকে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে এ রহস্যের সমাধান করার জন্য। অন্টারিও-র দক্ষিণ-পশ্চিমের এক হাওয়া-সুরঙ্গে সারা পৃথিবীর নামী সেতু-বিশেষজ্ঞ, বায়ু-তাত্ত্বিক এবং শব্দ-প্রযুক্তিবিদরা গোল্ডেন গেট সেতুর রেলিং-এর এক সমাকৃতি প্রতিরূপ নির্মাণ করে পরীক্ষানিরীক্ষা চালাচ্ছেন। আশার কথা এই যে, শিহরণ-জাগানো এই শব্দ থামানোর জন্য তাঁরা কী কী পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন তা জনগণের সামনে এ বছর গ্রীষ্মেই তাঁরা তুলে ধরতে পারবেন বলে প্রযুক্তিবিদদের তরফ থেকে জানানো হয়েছে।

গত বছরের জুন মাস থেকে শহরবাসীরা এই অদ্ভুত শব্দ নিয়ে অভিযোগ করতে শুরু করলে প্রথমে কিছুটা ধন্ধেই পড়ে গিয়েছিলেন সেতু দপ্তরের আধিকারিকরা। তাঁরা আওয়াজটাকে অনুসরণ করে, বিভিন্ন যন্ত্রপাতি দিয়ে শব্দতরঙ্গ মেপে দেখেন যে তার কম্পাঙ্ক ৪৪০ হার্টজের কাছাকাছি, সঙ্গীতের প্রেক্ষিতে ‘এ’ নোটের সঙ্গে তুলনীয়। আওয়াজটিকে অনুকরণ করে ওবো নামক পশ্চিমী শ্বাসবাদ্যে সুর লাগানো যেতে পারে, এই মর্মে পোস্টারও পড়েছিল সোশ্যাল মিডিয়াতে।

শহরজুড়ে যখন পশ্চিমী হাওয়া বয় পাগলপারা, সে হাওয়া কখনও কখনও সেতুর নবনির্মিত রেলিং-এর ওপর আছড়ে পড়ে অদ্ভুত কৌণিকতায়, যেমনটা সাধারণ ভাবে হওয়ার কথা তার চেয়ে অল্প উত্তর বা দক্ষিণ ঘেঁষে, আর সেই ঘর্ষণ থেকেই উদ্ভুত হয় এই গা-শিউড়ে ওঠা শব্দ, অবশেষে এই সিদ্ধান্তে এসেছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের মুখপাত্র পাওলো কসুলিশ-সোয়ার্টজ জানালেন, বিস্তারিত ভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পর তাঁরা বুঝতে পেরেছেন যে ব্রিজের পশ্চিম পাড়ে সদ্য বসানো রেলিং-এর বায়ুচলাচল-সংক্রান্ত বৈশিষ্ট্যের কারণে উদ্ভূত হয় এই শব্দ। আবহাওয়া পরিবর্তনের ফলে নানা গুরুতর প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটে চলছে বিশ্ব জুড়ে। এমন কোনও ঘটনার অকস্মাৎ অভিঘাতে যাতে গোল্ডেন গেট ব্রিজ ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে জন্য এক কোটি ডলারেরও বেশি ব্যয় করে তড়িঘড়ি এই কাজ করানো হয়েছে। ২০১৩ সালে পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছিল এই সেতু ঘণ্টাপ্রতি সর্বাধিক ৬৯.৩৪ মাইল গতিবেগ সম্পন্ন বাতাসের আঘাত সহ্য করার ক্ষমতা রাখে। এই সেতুর ৮৪ বছরের ইতিহাসে এর ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া বাতাসের গতিবেগ ঘণ্টাপ্রতি সর্বাধিক ৭৫ মাইল অবধি হয়েছে, এবং যতবার এই গতিবেগ ৬৯ মাইলের নির্ধারিত সীমা অতিক্রম করেছে, ব্রিজের ওপর দিয়ে যানবাহন ও মানুষ চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ১৯৩৭ সালে তৈরি গোল্ডেন গেট ব্রিজ অদ্যাবধি তিনবার অল্প অল্প সময়ের জন্য বন্ধ রাখা হয়েছিল, ১৯৫১, ১৯৮২ এবং ১৯৮৩ সালে। ফলে কখনও কোনও রকম উল্লেখযোগ্য ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। সেতুটি যাতে ঘণ্টায় ১০০ মাইল অবধি গতিসম্পন্ন হাওয়ার মুখেও সটান দাঁড়িয়ে টিকে যেতে পারে আরও অনেক বছর, সে কারণেই নতুন ভাবে সরু রেলিং দিয়ে ঘেরা হয় এই ব্রিজ। সোয়ার্টজ এ প্রসঙ্গে গ্যালোপিন গার্টি নামে সমধিক পরিচিত ট্যাকোমা ন্যারোজ ব্রিজের প্রসঙ্গও উত্থাপন করেন। ওয়াশিংটনের সেই রাহুগ্রস্ত সেতু ১ জুলাই ১৯৪০-এ চালু হওয়ার অব্যবহিত পর থেকেই বাতাসে দুলতে থাকে এবং মাত্র চার মাসের মধ্যে ভেঙে পড়ে। কী ভাবে ব্রিজ নির্মাণ করা উচিত নয় তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে গ্যালোপিন গার্টি তখন থেকেই সারা পৃথিবীতে সেতু-বাস্তুবিদ্যার কার্যক্রমে জায়গা করে নিয়েছে। ঘণ্টাপ্রতি ১০০ মাইল গতিবেগ সম্পন্ন বাতাস ১০,০০০ বছরে একবার বইলেও বইতে পারে। ন্যাশনাল ওয়েদার সার্ভিস-এর প্রাজ্ঞ বিজ্ঞান-বিষয়ক আধিকারিক ওয়ারেন ব্লায়ার মনে করেন এমন হাওয়া কেবলমাত্র টর্নেডো, হারিকেন বা ক্রান্তীয় ঝড়ের সময়ে বয় এবং এরকম বিধ্বংসী হাওয়া কোনও দিন সানফ্রান্সিসকোর আশেপাশে, এমনকী ক্যালিফোর্নিয়ার উত্তর উপকূল স্পর্শ করেছে বলে ব্লায়ার সাহেবের জানা নেই, ভবিষ্যতে বইতে পারে, এমন সম্ভাবনার কথাও তাঁর জানা নেই। দুর্ভাগ্যের বিষয়, যা কখনও ঘটবে কি না সেটাই ধোঁয়াশায় ঢাকা, তার জন্য আগাম সতর্কতা নিতে গিয়ে স্বাভাবিক দিনগুলোতে শহরবাসীদের ঠেলে দেওয়া হচ্ছে এক অস্বাভাবিক, অভূতপূর্ব, প্রায় ভৌতিক পরিস্থিতির মধ্যে। এটা বোধ করি বিশেষজ্ঞরা কেউই পূর্বানুমান করে উঠতে পারেননি।

এইসব চাপান উতোরের মধ্যেও কিন্তু সেতু প্রযুক্তিবিদরা তাঁদের কাজ করে চলেছেন, ব্রিজ থেকে উত্থিত অপ্রাকৃত শব্দ বন্ধ করার জন্য তাঁদের নিরলস প্রয়াস জারি রয়েছে। আশেপাশে বসবাসকারী মানুষ যে যন্ত্রণা ভোগ করে চলেছেন, সে সম্পর্কে তাঁরা যথেষ্টই সহানুভূতিশীল।

এর উল্টোদিকটাও কম মজার নয়। সানফ্রান্সিসকোর মানুষের অন্যতম চারিত্র হল যে কোনও মূল্যে স্বমতে অটল থাকা। এ শহরেই বেশ কিছু মানুষ আছেন যাঁরা চান না যে সেতু-নিঃসৃত ভৌতিক আওয়াজটি তাঁদের শ্রবণসীমা থেকে উধাও হয়ে যাক। একজন স্থানীয় ব্লগার এই ধ্বনিটিকে রেকর্ড করে তাঁর প্লে-লিস্টে রেখে দিয়েছেন। কেন জানেন? যদি বাতাসহীন রাতের নৈঃশব্দ্যে ঘুম না আসে, তবে তা চালিয়ে শুনতে শুনতে ঘুমোবেন। সানফ্রান্সিসকোর পশ্চিম প্রান্তে থাকেন ব্রিয়ানি হ'ওয়েল, সমুদ্র উপকূল ধরে হেঁটে যান রোজ। এমনই একদিন, বাতাসের আঘাতে ব্রিজ থেকে ভেসে আসছিল চাপা কান্নার মতো আওয়াজ আর চলমান সেই দৃশ্য ক্যামেরায় বন্দি করেছিলেন হ'ওয়েল। সেই ভিডিও তাঁর কাছে ভৌতিক সিনেমার অপ্রাকৃত সুরমুর্ছনার মতো, তিনি উপভোগ করেন ওই শিহরণটা। বলাই বাহুল্য, শব্দ-সমস্যার সমাধান হয়ে গেলে ব্লগার সাহেবের মতো তিনিও যারপরনাই দুঃখ পাবেন।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *