logo

বুদ্ধং শরণং (পর্ব-১৮)

  • August 17th, 2022
Memoir

বুদ্ধং শরণং (পর্ব-১৮)

সুমন চট্টোপাধ্যায়

২০০৬-এর বিধানসভা ভোটের আগে সম্ভবত অ্যাসোচেম রাজ্যের ব্যবসায়ীদের মধ্যে একটি সমীক্ষা চালিয়েছিল। তাতে একটি প্রশ্ন ছিল, রাজ্যের পরবর্তী মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে আপনি কাকে দেখতে চান? সব কয়টি ভোট পড়েছিল বুদ্ধদেবের পক্ষে। বুর্জোয়া পুঁজিপতিদের পছন্দের তালিকার সর্বাগ্রে একজন কমিউনিস্ট নেতা, ভাবলেই কেমন লাগে!

তাঁর সংস্কারমুখী, পুঁজি-বান্ধব ভাবমূর্তি তাঁর কমিউনিস্ট সত্ত্বাকে ধীরে ধীরে গ্রাস করে ফেলছে, বুদ্ধবাবু তা সম্যক অনুধাবন করতে পারতেন। তাই সুযোগ পেলেই তাঁর প্রকৃত পরিচয়টির কথা স্মরণ করিয়ে দিতেন। আমাকেই তিনি একাধিকবার বলেছেন, ‘দেখুন, যে যে ভাবেই ব্যাখ্যা করুন না কেন, শেষ বিচারে আমি একজন কমিউনিস্ট, মার্কসবাদে আমার আস্থা এতটুকুও টাল খায়নি, পুঁজি আর শ্রমের দ্বন্দ্ব সম্পর্কে আমি ওয়াকিবহাল। আমি এ কথাও বিশ্বাস করি, মানব সভ্যতার ইতিহাসের শেষ পরিচ্ছেদটি আমেরিকা লিখবে না।’

আর আমি সুযোগ পেলেই বুদ্ধবাবুর এই অস্বস্তিকর অবস্থান নিয়ে তাঁকে চিমটি কাটতাম। একবার তাঁকে বলেছিলাম, ‘আমাকে যদি বলেন আমি মার্গারেট থ্যাচারের সঙ্গে আপনার তুলনা করব। থ্যাচার বলতেন, তাঁর সংস্কারের মূলে রয়েছে একটা নৈতিক বিশ্বাস, হোয়াটেভার আই অ্যাম ডুয়িং ইজ নট আউট অব এক্সপিডিয়েন্সি বাট বিকজ আই ফিল দে আর মরালি কারেক্ট। আপনার গলাতেও তো আমরা একই নৈতিক বিশ্বাসের প্রতিধ্বনি শুনি। শুনি না কি?’

মার্গারেট থ্যাচারের নাম শুনলেই দুনিয়ার সব বামপন্থীর মতো বুদ্ধবাবুও বিরক্ত হতেন। ‘না, না, থ্যাচার-ফ্যাচারকে এর মধ্যে টেনে আনবেন না।’

তাহলে কার কথা বলব, দেং শিয়াও পিং?

বুদ্ধবাবুর শরীরের ভাষা বুঝিয়ে দিল এই তুলনাটা তাঁর মনে ধরেছে। কিন্তু তিনি নিরুত্তর রইলেন। সম্ভবত একথা আন্দাজ করে যে দেংয়ের সঙ্গে নিজের তুলনা মেনে নিলে তাঁকে ভবিষ্যতে অনেক অস্বস্তিকর প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। প্রসঙ্গটি ঘুরিয়ে দিতে অতএব তিনি বললেন, ‘কেন মিছিমিছি এই সব তুলনা টানছেন? যে যাঁর নিজের দেশের নিজস্ব পরিস্থিতির মধ্যে দাঁড়িয়ে কাজ করে, কারও সঙ্গে কারও মিল নেই।’

অফ-স্পিন, লেগ-স্পিন কোনওটাতেই কাজ হল না দেখে মরিয়া আমি একটা দুসরা ছাড়লাম। ‘ঠিক আছে, আমি এবার একটু অন্যরকম ভাবে প্রশ্নটা করছি। ধরুন আপনাকে যদি বলি কার সঙ্গে তুলনা করা হলে আপনি খুশি হবেন, আপনি কার নাম করবেন?’

হুগো শাভেজ। চোখের পলক পরার আগেই বুদ্ধবাবুর উত্তর। এক্কেবারে খুশিতে ডগমগ। ভেনেজুয়েলার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট, অতি বর্ণময় চরিত্র ছিলেন শাভেজ। পরবর্তীকালে বারেবারে তিনি তাঁর অবস্থান বদলেছেন কিন্তু গোড়ার দিকে শাভেজ ধনতন্ত্রের রাস্তা ধরেই অগ্রগতিতে বিশ্বাস করতেন। তবে সেই ধনতন্ত্র মার্কিন নিও-লিবারালিজম নয়, ভেনেজুয়েলার নিজস্ব। বস্তুত লাতিন আমেরিকার একটা বড় অংশ জুড়ে তখন ‘পিঙ্ক ওয়েভ’ চলছে যার মুখ হিসেবে উঠে এসেছেন শাভেজ। ১৯৯৯ সালে শাভেজ যখন ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট হন তেলের টাকার ওপর দেশটা ভাসছে। চোদ্দ বছর পরে শাভেজের যখন মৃত্যু হয়, ভেনেজুয়েলার তখন অবর্ণনীয় দুরবস্থা। সে যাই হোক, চিন্তাভাবনায় ওপর ওপর কিছু মিল থাকলেও শাভেজকে দেখে আমার কখনও বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কথা মনে পড়েনি।

বিনিয়োগ মানে শিল্প, শিল্প মানে কর্মসংস্থান, কর্মসংস্থানের সম্ভাবনার মানে বেকারির তমসায় ডুবে থাকা যুব সমাজের মধ্যে নতুন উদ্দীপনা। ২০০১ থেকে ২০০৬ সালের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে খুব একটা আহামরি পরিমাণ বিনিয়োগ আসেনি। আনুমানিক পাঁচ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু আরও অজস্র বিনিয়োগ আসতে পারে তেমন একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। একদিকে দেশজ শিল্পপতিদের ঢালাও প্রশংসা অন্যদিকে রাজ্যের পরিকাঠামো খাতে ইন্দোনেশিয়ার সালেম গোষ্ঠীর ৪০ হাজার কোটি বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি বামপন্থীদের সম্পর্কে বিরক্ত বাঙালি মধ্যবিত্তের একটা বড় অংশকে ফের বামমুখী করে তুলেছিল। এই সত্য প্রতিফলিত ২০০৬-এর ভোটে শহরাঞ্চলের ফলাফলে। এমনকী যে কলকাতায় বিরোধীদের একচেটিয়া দাপট ছিল সেখানেও বামেরা সিঁদ কাটতে সক্ষম হল। আমি রসিকতা করে বুদ্ধবাবুকে বলেছিলাম, ‘আপনার বৃহস্পতি তো একেবারে তুঙ্গে। মাঝেমধ্যে আমার মাথায় হাত রাখবেন যাতে সেই ভাগ্যের ছিটেফোঁটা আমিও পাই।’

বুদ্ধবাবুকে কখনও আমার চটকদার বক্তা বলে মনে হয়নি। তবে অন্য সকলের সঙ্গে তাঁর পার্থক্যটা ছিল মৌলিক, সেটা ওঁর ভাষণ শুনলে বেশ বোঝা যেত। রাজনীতিবিদের ভাষণকে আমরা সাধারণত ধর্তব্যের মধ্যে নিই না, আমরা ধরেই নিই, তিনি হয় অর্ধসত্য বলবেন অথবা অসত্য। বুদ্ধবাবু ছিলেন এই নিয়মে আমার দেখা সেরা ব্যতিক্রম। তিনি যখন বামফ্রন্টের দীর্ঘ শাসনের সুফলগুলির কথা বলতেন, যেমন ভূমি সংস্কার, পঞ্চায়েত ব্যবস্থা, ফসলের ফলন বৃদ্ধি, তাতে দম্ভের লেশমাত্র থাকত না। আবার সরকারের ব্যর্থতার জায়গাগুলি তিনিই চিহ্নিত করে দেখাতেন অকপটে। হ্যাঁ এত বনধ আর ধর্মঘট করে আমরা ঠিক করিনি, রাজনীতির অস্ত্র হিসেবে এগুলো এখন সম্পূর্ণ ভোঁতা হয়ে গিয়েছে। কিংবা আমি মানি পশ্চিমবঙ্গের মূল সমস্যাটা হল পারসেপশনের। বাইরের লোকেরা মনে করে এ রাজ্যে কাজ করা যায় না, এখানে বিনিয়োগ করা মানে টাকা জলে ফেলে দেওয়া। এই পারসেপশন বদল করাটাই আমাদের সামনে সবচেয়ে কঠিন চ্যালঞ্জ।

ভাবমূর্তি বদলানোর প্রচেষ্টা তারও অনেক আগে শুরু হয়েছিল, ১৯৯০-এর দশকের মাঝামাঝি, জ্যোতি বসু ও সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের যৌথ উদ্যোগে। এই ছয়-সাত বছরে বাংলায় কোনও বিনিয়োগ আসেনি এমনও নয়। রাজ্যে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ পুঁজি যে শিল্পে বিনিয়োগ হয়েছে সেই হলদিয়া পেট্রোকেমিক্যালস প্রাক-বুদ্ধ জমানার ঘটনা। একই কথা প্রযোজ্য মিৎসুবিশি কেমিক্যালের ক্ষেত্রেও। পূর্বসূরির বিলম্বিত উদ্যোগকে তুঙ্গ বিন্দুতে নিয়ে যাওয়ার কৃতিত্ব অবশ্যই বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের। তাঁর কাছে শিল্পায়ন ছিল অনেকটা ধর্মযুদ্ধ যেন, তিনি প্রধান জেহাদি। নিজের তৎপরতার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বুদ্ধবাবু যখন বলতেন, ‘প্রতি বছর হাজার হাজার ছেলেমেয়ে পাশ করে বের হচ্ছে। রাজ্যে এখন ৬৯টি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, এতগুলো বিশ্ববিদ্যালয়, এতগুলি পলিটেকনিক, এরা সব যাবে কোথায়?’ মনে হত কাকার মতো তিনিও রাজ্যটাকে শিশুদের বাসযোগ্য করে যেতে চান। হয়তো অত্যুক্তি হবে না যদি বলি, ইতিহাস বুদ্ধদেবকে হাতছানি দিয়ে ডেকেছিল। হি ওয়াজ ব্যাটিং ফর হিস্ট্রি।

ভোটের ফল প্রকাশের দিন আমি সকাল থেকেই কলকাতা টিভি-র স্টুডিওতে ছিলাম। বিকেলে সেখানে বুদ্ধবাবু সাংবাদিক বৈঠক করলেন। আমরা সেটা লাইভ দেখালাম। আমাদের পক্ষ থেকে আলিমুদ্দিনে উপস্থিত ছিল অর্কপ্রভ সরকার। তাকে বলা ছিল বৈঠক শেষ হলেই ও যেন মোবাইল ফোনে বুদ্ধবাবুর সঙ্গে আমার কথা বলায়। আমার কিঞ্চিৎ ভয় ছিল মুখ্যমন্ত্রী হয়ত রাজি হবেন না। ভুল ভেবেছিলাম। টেলিফোন কানে নিয়েই আনন্দে আত্মহারা বুদ্ধবাবু আমার কোর্টে বলটা ঠেলে দিয়ে বলে উঠলেন, ‘আপনাকে বলেছিলাম না এবার আমরা উন্নততর বামফ্রন্ট গঠন করব? যা বলেছিলাম তা মিলল তো?”

অনুষ্ঠান শেষে পা বাড়ালাম আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের দিকে। গিয়ে দেখি, লাইব্রেরি কক্ষে মুখ্যমন্ত্রী কমরেড পরিবৃত হয়ে বসে গল্প করছেন। পার্টির কোনও গোপন আলোচনা নয়, ফলে একটি চেয়ার টেনে নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর পাশে বসতে কোনও অসুবিধে হল না। আলোচনার ফাঁকে চাপা গলায় বুদ্ধবাবু বললেন, ‘আপনাকে একটা ভালো খবর দিই, এখন দেখাবেন না কিন্তু। একটু আগে রতন টাটার চিঠি পেলাম। টাটারা আসছে।’

(বুদ্ধনামার শেষ পর্ব ফের দিন কতক পরে)

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *