logo

বুদ্ধং শরণং (পর্ব-১৭)

  • August 17th, 2022
Memoir

বুদ্ধং শরণং (পর্ব-১৭)

সুমন চট্টোপাধ্যায়

পাঁচ বছরের মুখ্যমন্ত্রিত্বে এমন কী করেছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য যে রাজ্যবাসী এমন মাথায় করে তাঁকে ফের মহাকরণে ফিরিয়ে এনেছিল? আর যাই হোক তাঁর হাতে তো কোনও জাদুদণ্ড ছিল না!

একটা কারণ তিনি সিপিএম দলের বিশ্বস্ত সৈনিক হলেও মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে বসে আগ-মার্কা সিপিএম নেতার মতো আচরণ করেননি। বরং তাঁর বাস্তবমুখী স্পষ্ট কথাবার্তা, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলাতে চাওয়ার আন্তরিক অভিপ্রায়, আত্মপ্রত্যয়, ভুল স্বীকারের ঔদার্য, সাদাকে সাদা কালোকে কালো বলার দুর্মর সাহস দেখে তিনি সত্যিই সিপিএম নেতা কি না তা নিয়ে বিভ্রম হতো। এতদিন স্থিতাবস্থা আর দলীয় স্বার্থ রক্ষা ছাড়া যে দল বাকি কোনও কিছুকেই প্রয়োজনীয় বলে মনে করেনি, তাদের একজন নেতা ক্রিজের বাইরে এসে একের পর এক ছক্কা হাঁকাবেন, কে ভাবতে পেরেছিল?

বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ক্ষমতাসীন হওয়ার অল্প কিছু দিনের মধ্যেই বহির্জগৎ টের পেল পশ্চিমবঙ্গে নতুন হাওয়া বইছে, কোনও এক রাজপুত্তুর এসে তাসের দেশের সব কিছু এলোমেলো করে দিচ্ছেন। তিনি কখনও বলছেন কৃষি থেকে শিল্পে উত্তরণই সভ্যতার অগ্রগতির অমোঘ নিয়ম। কখনও বলছেন, ‘আইদার উই রিফর্ম অর পেরিশ’, অনবরত বলে চলেছেন, ‘শিল্প তো আর আকাশে হবে না’। কখনও আবার ‘ক্যাপিটালিজমকে ব্রাত্য করে টিকে থাকা যায় কি?’। সরকারি কর্মচারীদের বলছেন, কাজ করতে হবে এবং এখনই করতে হবে। পার্টিকে বোঝাচ্ছেন রাজ্যটাকে বাঁচাতে হলে পুঁজির চরিত্র দেখে লাভ নেই, বিনিয়োগ চাই, বিদেশি বিনিয়োগও চাই। যে কোনও মূল্যে চাই।

পশ্চিমবঙ্গের লাল কেল্লার মাথা থেকে এমনতরো অপরিচিত বজ্র-নির্ঘোষ কেউ কখনও শোনেনি। শুনেছে, 'বনধ, ধর্মঘট মেহনতি মানুষের মৌলিক অধিকার’, কিংবা ‘এ লড়াই বাঁচার লড়াই, এ লড়াইয়ে জিততে হবে’, কিংবা ‘টাটা বিড়লার কালো হাত ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও।’ দেখেছে কো-অর্ডিনেশন কমিটি করলে আর কাজ করার প্রয়োজন হয় না, লালরঙা সংগঠনে নাম লেখালে শিক্ষকদের ক্লাস করার দরকার হয় না, দলের নামে সাত খুনও মাফ হয়ে যায়, পাড়ায় পাড়ায় দাদা-বৌদির ঝগড়াও লোকাল কমিটির হস্তক্ষেপ ছাড়া মেটে না। দলতন্ত্র, দলতন্ত্র, দলতন্ত্র। দলতন্ত্র কেবলম।

বুদ্ধবাবু মহাকরণে মুখ্যমন্ত্রীর আসনে বসার পরে অত্যাশ্চর্য স্বাদ-বদল হল, বোঝা গেল হি ইজ এ ম্যান উইথ এ মিশন। তার চেয়েও বড় কথা সেই মিশন আদপেই দলের সেবা করা নয়, দলীয় স্বার্থ গুরুত্বপূর্ণ হলেও রাজ্যের সামগ্রিক স্বার্থের চেয়ে অনেক নীচে। এমন একজন মুখ্যমন্ত্রী যাঁর ‘কমিটমেন্ট’ নিখাদ, হাততালি পাওয়ার অভিপ্রায়-হীন, ব্যক্তি অথবা দল কোনও ক্ষুদ্র স্বার্থের জায়গা নেই সেখানে। এক্কেবারে ঠিক সময়ে ঠিক মানুষটির উঠে আসা।

এই যেমন দশকের পর দশক ধরে টালবাহানা করার পরে বুদ্ধবাবু চকিতে সিদ্ধান্ত নিলেন প্রেসিডেন্সি কলেজকে স্বায়ত্তশাসন দিতেই হবে। অর্থাৎ সরকারি শিক্ষায় ‘এলিটিজমের’ কোনও স্থান থাকতে পারে না বলে যাঁরা কাঁসর-ঘণ্টা বাজাচ্ছিলেন, কলমের এক খোঁচায় বুদ্ধবাবু তা নস্যাৎ করে দিলেন। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্সিকে স্বায়ত্তশাসন দেওয়ার সিদ্ধান্ত ছিল ‘প্যারাডাইম শিফট’। প্রেসিডেন্সির প্রাক্তনী বলে নিজের কলেজ সম্পর্কে বুদ্ধবাবুর দুর্বলতা ছিল, অনেক সময় কথায় বার্তায় আমি তার পরিচয় পেয়েছি। আমি রাজ্যের অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুপ্তর বিরুদ্ধে লাগাতার লিখতাম বলে বুদ্ধবাবু একদিন আমার হাত দু’টো ধরে অনুরোধ করলেন, আমি, অসীম, আপনি তিন জনেই প্রেসিডেন্সির ছাত্র। অন্তত সেই কারণে আপনার এতটা অসীম-বিরোধী হওয়া উচিত নয়। অসীম মাঝে মাঝেই আমার কাছে অনুযোগ করে সুমনকে আমি এত পছন্দ করি, তাও আমাকে ও শুধুই গালাগালি করে। তবে স্বায়ত্ত্বশাসন দেওয়ার সিদ্ধান্তের সঙ্গে ব্যক্তিগত দুর্বলতার কোনও সম্পর্ক ছিল না। কেননা মুখ্যমন্ত্রী বুক চিতিয়ে বলতেন, 'সেন্টার অব এক্সেলেন্স থাকবে না এটা আবার কোনও কথা হল নাকি? কমিউনিস্ট রাশিয়ায় ছিল না? চিনে নেই? মুড়ি আর মিছরির যে একদর হয় না এই বাস্তবটা আমাদের মানতে হবে।

এ কথা অনস্বীকার্য, দল বুদ্ধদেববাবুর স্বপ্নের পথে কাঁটা বিছোনোর তেমন কোনও চেষ্টা করেনি। কলকাতায় দলের রাজ্য সম্পাদক অনিল বিশ্বাস ছিলেন মুখ্যমন্ত্রীর সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য খুঁটি, রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলী বা রাজ্য কমিটির বৈঠকে বুদ্ধবাবুর প্রস্তাবগুলি গ্রাহ্য হতো বিরোধিতা ছাড়াই। দলের বর্ধমান লবির অন্যতম নেতা নিরুপম সেন শিল্পমন্ত্রী হওয়ার পরে দলীয় সমর্থনের রাস্তাটা আরও মসৃণ হয়ে গিয়েছিল। বুদ্ধবাবুর মতো নিরুপমবাবুও ছিলেন শিল্পায়নে নিবেদিত প্রাণ, তাঁর সাধ্যমতো আন্তরিক ভাবেই তিনি মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সঙ্গত করার চেষ্টা করেছিলেন। এমনকী প্রকাশ কারাট অ্যান্ড কোম্পানিও সাপের ছুঁচো গেলার মতো বুদ্ধবাবুর শিল্পনীতিতে সায় দিয়েছিল। সিঙ্গাপুর-ইন্দোনেশিয়া সফরের পরে বুদ্ধবাবু দলের পলিটব্যুরোয় একটি রিপোর্ট জমা দিয়েছিলেন। পরে সাংবাদিক বৈঠকে সীতারাম ইয়েচুরি বলেছিলেন, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী যা করছেন তাতে তাঁরা আপত্তিকর কিছুই দেখছেন না।

পুঁজির সন্ধানে বুদ্ধবাবুর নিরলস প্রয়াস তাঁর এমন একটি ‘কনস্টিটুয়েন্সি’ তৈরি করেছিল যা কোনও মার্কসবাদী মুখ্যমন্ত্রীর ক্ষেত্রে ভাবাই যায় না। ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের কনস্টিটুয়েন্সি। উইপ্রোর কর্ণধার, তখন সম্ভবত দেশের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি আজিম প্রেমজি কলকাতায় তাঁদের সংস্থার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এসে প্রকাশ্যেই বলে ফেললেন, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যই এখন দেশের সেরা মুখ্যমন্ত্রী। অন্ধ্রপ্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু নাইডুর তুলনা টেনে তিনি বলেছিলেন, বুদ্ধদেববাবুর কাজটা আরও কঠিন, তাঁর দলের ভিতরেই নানা সমস্যা আছে। প্রেমজির সোজা সাপ্টা ব্যাখ্যা ছিল, অর্থনীতিতে সংস্কার কত দ্রুতহারে এগোবে তা সম্পূর্ণ ভাবে নির্ভর করে রাজনৈতিক নেতাদের সদিচ্ছার ওপর। এই সদিচ্ছার প্রশ্নে ভারতে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী নেই।

কলকাতায় সিআইআই-এর একটি সম্মেলনে যোগ দিতে এসে প্রেমজির কথায় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং স্বয়ং শিলমোহর লাগিয়ে দিলেন। সঙ্গে ভূয়সী প্রশংসা পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর। বললেন, ‘কাগজে যখন পড়লাম আজিম প্রেমজি বুদ্ধবাবুকে দেশের সেরা মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, আমি এতটুকুও অবাক হইনি। কেন না আমার সুচিন্তিত অভিমতও তাই। আমি মনে করি, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর মতো দূরদ্রষ্টা, সাহসী আরও অনেক রাজনৈতিক নেতার প্রয়োজন আমাদের দেশে। এমন নেতা যাঁরা আধুনিকীকরণের চ্যালেঞ্জগুলির মর্মার্থ বোঝেন।’ এখানেই থেমে না গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলতে থাকেন, অনেক গুলি কারণে বুদ্ধবাবুকে আমি শ্রদ্ধা করি, তাঁর প্রজ্ঞা ও রসবোধ, সংবেদনশীল হৃদয় ও মস্তিষ্ক, বিশ্বাসের প্রতি একনিষ্ঠতা, সর্বোপরি গোটা দেশ, বিশেষ করে বাংলার খেটে খাওয়া মানুষের প্রতি সহমর্মিতা। আজ যদি দিল্লি আর কলকাতা এক সুরে কথা বলে থাকে তার সবচেয়ে বড় কারণ বুদ্ধদেববাবু এবং আমি যে সব ধ্যান ধারণা, মতামত পোষণ করি, এ দেশের মানুষ তাকে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে সমর্থন করেছেন।

নিউ ইয়র্কের একটি শিল্প সমাবেশে তাঁর একটি অভিজ্ঞতার কথাও এ প্রসঙ্গে সকলকে জানিয়ে দেন প্রধানমন্ত্রী। ওই সমাবেশে একটি মহল থেকে বারবার ইউপিএ সরকারের বাম নির্ভরতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছিল। আমার সাহায্যে তখন পূর্ণেন্দু চট্টোপাধ্যায় এগিয়ে এসে বলেন, পশ্চিমবঙ্গে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সরকার যদি পুঁজি-বান্ধব হতে পারে তাহলে ভারত সরকার পারবে না কেন?
প্রধানমন্ত্রীর বেঁধে দেওয়া সুরে তারপরে গলা মেলালেন রতন টাটা, তৎকালীন সিআইআই চেয়ারম্যান সুনীলকান্ত মুঞ্জল, আইটিসি-র চেয়ারম্যান যোগী দেবেশ্বর। ভারতীয় শিল্পজগতের হুজ হু ধীরে ধীরে আমার মতোই বৌদ্ধ হয়ে গেল।(চলবে)

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *