logo

টাকা লাগে দেবে গৌরী সেন

  • August 16th, 2022
Memoir

টাকা লাগে দেবে গৌরী সেন

সুমন চট্টোপাধ্যায়

কলকাতায় থাকাকালীন সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার মৌখিক পরিচয় ছিল তবে ওইটুকুই। ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল ৮৫ সালে আমি দিল্লিবাসী হওয়ার পরে। দলের অথবা ট্রেড ইউনিয়নের কাজে তিনি যতবার দিল্লি আসতেন অবধারিত ভাবে আমাদের আড্ডা হতো। হয় আমার বাড়িতে নয় অফিসে। তবে বেশিরভাগ সময় ওঁর হোটেলের ঘরে। প্রিয়বাবু ছাড়া তাঁদের প্রজন্মের অন্য কোনও নেতার সঙ্গে আমার এতটা নৈকট্য তৈরি হয়নি।

সে সময় দিল্লিতে এলে বাংলার নেতানেত্রীরা প্রায় সবাই বঙ্গভবনে উঠতেন। রাজধানীতে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের দু’টি অতিথিশালা আছে, একটি সার্কুলার রোডে, ডিপলোম্যাটিক এনক্লেভের সন্নিকটে, অন্যটি কনট প্লেসের কাছে হেইলি রোডের ওপর। এই দ্বিতীয় অতিথিশালাটির নামই বঙ্গভবন। এখন দু’টি অতিথিশালাই ঝাঁ চকচকে হয়ে গিয়ে, আশির দশকে তেমন ছিল না। সার্কুলার রোডের অতিথিশালা ছিল একটি ছোট দোতলা বাড়ি, মুখ্যমন্ত্রী বা হেভিওয়েট মন্ত্রীরা সেখানে থাকতেন।

আর বঙ্গভবনকে দেখে মনে হতো সস্তার ইয়ুথ হস্টেল। দেশলাইয়ের বাক্সের মতো ছোট ছোট ঘর, কার্পেটে সোঁদা গন্ধ, বাসন-কোসন দেখলে পেটের জ্বলন্ত খিদেও ঠান্ডা হয়ে যেত নিমেষে। দেশের অন্য কোনও রাজ্যের সরকারি অতিথিশালার এমন হতশ্রী চেহারা ছিল না, বঙ্গসন্তান হিসেবে বেশ লজ্জাই হতো। এখন অবশ্য এদের আর সেই দুয়োরানি দশা নেই, ঝাঁ চকচকে ব্যাপার স্যাপার।

সুব্রত মুখোপাধ্যায় রইস মানুষ। তিনি বঙ্গভবনের ছায়াও মাড়াতেন না। তিনটি আই টি ডি সি হোটেলের যে কোনও একটায় তিনি উঠতেন। হয় জনপথ, নয় অশোক, নয় সম্রাট। প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের খুব কাছে সম্রাট হোটেলটিই ছিল তাঁর সবচয়ে পছন্দের। বারেবারে সেখানে ওঠার সুবাদে সম্রাটে তিনি সম্রাটেরই মর্যাদা পেতেন। আড্ডা মারতে কতবার যে সেই হোটেলে গিয়েছি!

কাগজে কলমে রাজ্যের এক বিধাযক বইতো আর কিছু নন, তাহলে পঞ্চতারকা হোটেলে বারেবারে উঠতেন কীসের জোরে? সুব্রতবাবুর এইটুকু সততা ছিল, খোলাখুলিই স্বীকার করতেন তাঁকে টাকা জোগান গৌরী সেন। তাঁর আসল নাম অমর সিং। দিল্লিতে গেলেই সুব্রতবাবুকে রসে-বশে রাখার সব দায়িত্ব অমরের। অমরের সৌজন্যে দিল্লিতে সুব্রতবাবুর একটি লাল রঙের ছোট মারুতি গাড়িও জুটেছিল। দিল্লিতে থাকাকালীন সেই মারুতিটি ছিল সুব্রতর বাহন, নিজেই ড্রাইভ করে ঘুরে বেড়াতেন। বাকি সময়ে গাড়িটি পড়ে থাকত প্রিয়রঞ্জনের জনপথের বাংলোয় একটা গাছের তলায়।

কালে কালে অমর সিং রাজনীতি ও বলিউডের হুজ হু-র একজন হয়ে উঠেছিলেন। ব্যবসা করতে গিয়ে অমিতাভ বচ্চনের যখন সর্বস্বান্ত অবস্থা তাঁকে উদ্ধার করার কাজে অমরের অবদান কম ছিল না। একদা মুলায়ম সিং যাদব ও তাঁর পুত্রের মুখ্য উপদেষ্টা ছিলেন, সমাজবাদী পার্টির টিকিট নিয়ে রাজ্যসভার সদস্যও হয়েছেন। এত কম পুঁজি নিয়ে এই উচ্চতায় পৌঁছতে আমি আর কাউকে দেখিনি। অমরের সঙ্গে আমার শেষ দেখা বছর তিনেক আগে, কলকাতাতেই কোনও একটা সেমিনারে। দুটো কিডনিই অচল হয়ে গিয়েছে, কঙ্কালসার চেহারা, চিকিৎসার জন্য বছরের বেশিরভাগ সময় সিঙ্গাপুরেই থাকতেন, সেখানকার হাসপাতালেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ। মৃত্যুর দিন কয়েক আগে এক ভিডিয়ো বার্তায় খুবই আবেগ মথিত গলায় অমিতাভ বচ্চনের কাছে অমর ক্ষমা প্রার্থনা করেছিলেন, বিগ বি-ও তার জবাব দিতে কার্পণ্য করেননি।

এই অমর সিংহ আদতে কলকাতার বড়বাজারের ছেলে, সেখানেই বড় হয়ে ওঠা, কলেজে ঢুকে ছাত্র পরিষদে নাম লেখানোর পর থেকে সুব্রত মুখোপাধ্যায় তাঁর নেতা। প্রায় একলব্যের মতো ভক্তি। গোলগাল নধরকান্তি চেহারা, অল্প বয়স থেকেই মাথায় টাক, উচ্চারণ গ্রাহ্যের মধ্যে না আনলে বাংলাটাও তরতর করে বলত। সেই বড়বাজারের ‘সু্বতদা জিন্দাবাদ’ বলা ছেলে একদিন ভারতবর্ষের সবচেয়ে প্রভাবশালী ‘পাওয়ার ব্রোকার’ হিসেব প্রস্ফুটিত হবে, কেউ কি তা কল্পনা করেছিল?

আশির দশকের গোড়ায় অমর কলকাতা ছেড়ে দিল্লিতে থিতু হয়। কী ভাবে বলতে পারব না, হঠাৎ দেখা গেল অমর কে কে বিড়লার অতি ঘনিষ্ঠজন হয়ে উঠেছে, তারপরে গোয়ালিওরের মহারাজ কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মাধব রাও সিন্ধিয়ার। বিড়লা পরিবারের সঙ্গে সিন্ধিয়াদের এমনিতেই ঘনিষ্ঠতা ছিল, অমর এবার সিন্ধিয়ার বলয়ে ঢুকে পড়ে ডালপালা মেলতে শুরু করল। ট্রেড ইউনিয়ন করতেন বলে কে কে বাবুর আলাপ পরিচয় ছিল, অমরের সৌজন্যে তা নিকটতর হল। ধীরে ধীরে বিড়লা-সিন্ধিয়া সম্প্রসারিত পরিবারের একজন সদস্য হয়ে উঠলেন সুব্রত মুখোপাধ্যায়।

সুব্রতদার জন্য এত কাঁড়িকাঁড়ি টাকা অমর কেন খরচ করত, দিল্লিতে সুব্রতদা এলে যাতে পান থেকে চুন না খসে সেদিকে সদা-সতর্ক নজর রাখত, আমার বোধগম্য হতো না। সুব্রতদার কাছ থেক অমরের তখন কোনও কিছুই পাওয়ার ছিল না, বরং দিল্লির ক্ষমতার অলিন্দে অমরই ছিল তার একদা নেতার পাসপোর্ট। সুব্রতবাবুর বাইরে আমার সঙ্গে অমরের বন্ধুত্ব ছিল, মাঝেমাঝেই ও আমাকে বিবিধ পাঁচতারা হোটেলে নিয়ে যেত লাঞ্চ কিংবা ডিনার খাওয়াতে। খবরের সূত্র হিসেবেও অমর আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল, সব ঘাটে জল খেয়ে বেড়াত বলে। পেশার কাজেও অমর আমায় সাহায্য করেছে বেশ কয়েকবার। গোয়ালিওরের জয়বিলাস রাজপ্রাসাদে যখন জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়ার রূপকথার বিয়ে অনুষ্ঠিত হল, অমরই আমায় রাজবাড়ির অন্দরমহলের কথা পৌঁছে দিত।

তাই বলে সুব্রতদার জন্য এত কিছু করা কীসের প্রয়োজনে। অমরের জবাবটি এখনও আমার কানে বাজে। ‘সুব্রতদা আমার আদি গুরু, তাঁকে ভোলাটা হবে মহাপাপ। ভুলে যেও না আমি একজন রাজপুত, বাঙালি নই।’ (চলবে)

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *