logo

কট্টরপন্থী রইসির জয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া

  • August 16th, 2022
News

কট্টরপন্থী রইসির জয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া

নিজস্ব প্রতিবেদন: প্রায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ইরানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন ইব্রাহিম রইসি। ২০১৯ সাল থেকে দেশের প্রধান বিচারপতির দায়িত্বে, কট্টরপন্থীদের চোখের মণি, সুপ্রিম লিডারের সম্ভাব্য উত্তরসূরি, গণহত্যায় অভিযুক্ত। আশ্চর্যের নয় যে, চূড়ান্ত বিতর্কিত এই চরিত্রের নির্বাচনে পোশাকি অভিনন্দন বার্তার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক দুনিয়ার একটা অংশ সমালোচনায় মুখর।

ইরানে শিয়া ধর্মগুরুদের মধ্যে মাঝামাঝি পদে থাকা ৬০ বছরের রইসি সুপ্রিম লিডার আয়াতুল্লাহ আলি খামেইনির প্রিয় শিষ্য। গুরুর মতোই কালো পাগড়ি পরেন। যা চিনিয়ে দেয়, তিনি একজন সৈয়দ― নবি মহম্মদের বংশধর। খুব সম্ভবত ৮২ বছরের খামেইনির মৃত্যুর পর তিনিই হবেন পরবর্তী সুপ্রিম লিডার। কর্মজীবনের বেশিরভাগ সময় বিচারবিভাগের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকেছেন। ২০১৯ সালে তাঁকে দেশের প্রধান বিচারপতির আসনে বসান খামেইনি। অগস্টের গোড়ায় বিদায়ী প্রেসিডেন্ট হাসান রৌহানির কাছ থেকে দায়িত্ব আসবে তাঁর হাতে।

শুরুটা ছিল সাদামাটা। উত্তর-পূর্ব ইরানের মাশহাদ শহরে জন্ম। শিয়া ধর্মগুরুর পরিবারে বেড়ে ওঠা রইসির পোশাকি শিক্ষা শুরু হয় ১৫ বছর বয়সে কোমের এক ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। সেখানেই খামেইনির সংস্পর্শে আসা। প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে শিক্ষাগত যোগ্যতা জানানোর সময় অবশ্য রইসি দাবি করেছেন, কোমের ছ'বছরের শিক্ষাজীবনের পাশাপাশি আইনে ডক্টরেট ডিগ্রি রয়েছে তাঁর। ১৯৭৯ সালের যে বিপ্লব ইরানের মার্কিন-সমর্থিত সরকারের গদি উল্টে দিয়েছিল, তাতে সক্রিয় ভূমিকা নেন। বিপ্লব শেষ হওয়ার পর সরকারি আইনজীবী হিসেবে কাজ শুরু। কয়েক বছর বিভিন্ন বিচারবিভাগীয় এলাকায় কাজ করার পর ১৯৮৫ সালে তেহরানের ডেপুটি প্রসিকিউটর। যে পদে থাকার সময় গণহত্যায় নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে রইসির বিরুদ্ধে।

১৯৮৯ সালে আয়াতুল্লাহ খামেইনি সুপ্রিম লিডার হওয়ার পরেই বিচারবিভাগের অন্দরে তরতরিয়ে উন্নতি হতে থাকে তাঁর শিষ্যের। তেহরানের প্রসিকিউটর থেকে ধাপে ধাপে দেশের উপপ্রধান বিচারপতি। যে দায়িত্বে তিনি ছিলেন এক দশক। ২০১৪ সালে দেশের অ্যাটর্নি জেনারেলের পদে উন্নতি এবং তার তিন বছর পর প্রথম বার প্রেসিডেন্ট পদের লক্ষ্যে দৌড়। সে বার রৌহানির কাছে হারলেও ব্যর্থতার স্বাদ দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ২০১৯ সালে তাঁকে প্রধান বিচারপতি নিযুক্ত করেন খামেইনি। আর তার পরেই দুর্নীতির কঠোর বিরোধী হিসেবে নিজের ভাবমূর্তি তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন রইসি।

ইতিমধ্যে বিচারবিভাগের বাইরেও ক্ষমতা বেড়েছে তাঁর। ২০০৬ সালে দক্ষিণ খোরাসান থেকে 'অ্যাসেম্বলি অফ এক্সপার্টস'-এর সদস্য নির্বাচিত হন। এখনও সেই পদ ধরে রেখেছেন। সুপ্রিম লিডারের মৃত্যুর পর তাঁর উত্তরসূরি ঠিক করার দায়িত্ব এই সংস্থার। ২০১৬ সালে রইসির হাতে আস্তান-এ-কুদস রজভি ট্রাস্টের দায়িত্ব তুলে দেন খামেইনি। মাশহাদ শহরে অবস্থিত ইমাম রেজার সমাধি চত্বর ও অনুসারী সংগঠনগুলির পরিচালনার দায়িত্বে থাকা এই ট্রাস্টের তহবিল বিরাট। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর ভবিষ্যৎ সুপ্রিম লিডার হিসেবেও তাঁর দাবি আরও জোরদার হল।

দেশের ভিতরে, বিশেষ করে কট্টরপন্থী সংগঠনগুলির কাছে জনপ্রিয় রইসির আন্তর্জাতিক মহলে অবস্থান অবশ্য নড়বড়ে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের একাধিক অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে। ইরানি ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলির দাবি, ১৯৮৮ সালে ইরাক-ইরান যুদ্ধ শেষ হওয়ার মাস কয়েক পর কয়েক হাজার রাজনৈতিক বন্দিকে গুম করে মেরে ফেলে তেহরান। এই পুরো প্রক্রিয়া দেখভাল করে চার সদস্যের একটি অঘোষিত 'মৃত্যু কমিশন' যার একজন সদস্য ছিলেন শহরের তৎকালীন ডেপুটি প্রসিকিউটর রইসি। এরপর তিনি যখন দেশের উপপ্রধান বিচারপতি, সে সময় ২০০৯ সালের গণ অভ্যুত্থান শুরু হয়, যা দমন করার ক্ষেত্রেও তাঁর ভূমিকা বিতর্কিত। ১৯৮৮ সালের গণহত্যা এবং ২০০৯ সালের বিদ্রোহ দমনে তাঁর ভূমিকার জন্য দু'বছর আগে রইসির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে আমেরিকা। রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, ১৯৮৮ সালের ঘটনা 'মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ' হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। কাজেই বাইরের দুনিয়ায় রইসির ভাবমূর্তি বিশেষ সুবিধার নয়।

তার ছাপ তাঁর জয়ের পরে আন্তর্জাতিক মহলের মিশ্র প্রতিক্রিয়াতেও। এক দিকে রাশিয়া, তুরস্ক, সিরিয়া, ইরাক, কুয়েত, কাতার, ইয়েমেনের মতো দেশগুলো রইসিকে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছাবার্তা পাঠিয়েছে, দ্বিপাক্ষিক কূটনৈতিক সম্পর্কের উন্নতি হবে বলে আশা প্রকাশ করেছে। অন্য দিকে, ইরানের মানুষ ‘মুক্ত ও নিরপেক্ষ নির্বাচন প্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়ার সুযোগ পাননি’ বলে আক্ষেপ জানিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ইজরায়েলের নতুন জোট সরকারের প্রধানমন্ত্রী নাফতালি বেনেট তাঁর মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠক শুরু করেছেন রইসির নিন্দা দিয়ে। তাঁর কথায়, ‘খামেইনি যাঁদের বেছে নিতে পারতেন, তাঁদের সবার মধ্যে তেহরানের ফাঁসুড়েকেই তাঁর পছন্দ হল।’

ঘরের মাঠে রইসি এই মুহূর্তে নিশ্চিন্ত। কট্টরপন্থীরা তাঁর সমর্থনে এককাট্টা। বহুদিন ধরেই রইসির মানবাধিকার লঙ্ঘনের যাবতীয় অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে আসছেন তাঁরা। তার চেয়েও বড় কথা, কট্টরপন্থীদের সমর্থন ও সক্রিয়তার জোরেই তাঁর প্রেসিডেন্ট পদ জেতা। কারণ, জনা কয়েক কট্টরপন্থী ছাড়া এ বারের নির্বাচনে কাউকে দাঁড়াতেই দেওয়া হয়নি―মধ্যপন্থীরা তো দূরস্থান, রক্ষণশীলদেরও না। আর ভোট দিয়েছেন নাগরিকদের অর্ধেকেরও কম। রাজনৈতিক বিরোধিতা নয়, এই মুহূর্তে রইসির সামনে আসল সমস্যা দেশের অর্থনৈতিক সঙ্কট। পরমাণু কূটনীতির গেরোয় হাঁসফাঁস অবস্থা ইরানের অর্থনীতির। আমেরিকা ইরানের ওপর শাস্তিমূলক নিষেধাজ্ঞা জারির পর দেশে মুদ্রাস্ফীতি আকাশছোঁয়া, কর্মসংস্থান প্রায় শূন্য, বাজেট ঘাটতি ঊর্ধ্বমুখী। গোদের ওপর বিষফোঁড়া অতিমারী পরিস্থিতি। মুদ্রাস্ফীতি ও বেকারি সামাল দেওয়া আর পরমাণু নীতি নিয়ে কূটনৈতিক আলোচনার ইতিবাচক সমাপ্তিতে পৌঁছনো―এখন এই জোড়া চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি ভাবী প্রেসিডেন্ট।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *