- August 13th, 2022
 
দেবদূত দর্শন, আরও একবার
শুভেন্দু দেবনাথ
গত ২৬ মে প্রচণ্ড খাটাখাটনিতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম একটু তাড়াতাড়িই। তাড়াতাড়ি বলতে রাত ২টো নাগাদ। সারাদিনের ক্লান্তি তার উপর বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে কাজ, শরীর একদম ছেড়ে দিয়েছিল। রাত তিনটে নাগাদ ফোন বাজে। রোজকার অভ্যাসবশত রিসিভ করে ঘুম জড়ানো গলায় হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে একটি ছেলের গলা ভেসে আসে। ‘দাদা আমার নাম অজয় দাস। চিড়িয়ামোড়ের কাছ থেকে ফোন করছি। এক বন্ধুর কাছ থেকে আপনার নম্বর পেয়েছি। সন্ধে থেকে মা ঠিক ছিল, কিন্তু এখন হঠাৎ করে শ্বাসকষ্ট, সঙ্গে খিঁচুনি উঠছে, আর অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে। কাউকে পাচ্ছি না দাদা, আমি আর মা থাকি, অনেক জায়গায় ফোন করেছি, মাকে একটু হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে, নইলে বাঁচানো যাবে না। মা ছাড়া আমার আর কেউ নেই।’ এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলতে বলতেই প্রায় কেঁদে ফেলে ছেলেটি।
ততক্ষণে আমারও ঘুম কেটে গিয়েছে। তাই রূঢ় হলেও প্রশ্ন করি, সরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাবে না, বেসরকারিতে। ওপাশ থেকে কান্না জড়ানো গলায় উত্তর আসে, ‘দাদা সরকারি হলে খুব ভালো হয়। আমি খবরের কাগজ দেওয়ার কাজ করি, আর মা আয়ার কাজ করে।’ দ্রুত অবস্থা বুঝে যাই। তাকে বলি আমি দেখছি, চিন্তা কোরো না। বলে তো দিলাম এদিকে পকেটে রয়েছে সাকুল্যে হাজার পাঁচেক টাকা, যা রাখা ছিল কয়েক জনের ওষুধের কেনার জন্য। দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি যা হোক দেখা যাবে আগে এই মহিলাকে হাসপাতাল পৌঁছনোর ব্যবস্থা করা যাক। ওষুধের জন্য পাড়ার ওষুধের দোকানের প্রতাপ আছে, ওর কাছ থেকে ধারে নিয়ে নেওয়া যাবে।
আবারও ছেলেটিকে ফোন করে ঠিকানা চাই। থাকে সেই চিড়িয়া মোড় পেরিয়ে অষ্টমঙ্গলা ঘাটের কাছাকাছি। কিন্তু আমি যাব কী ভাবে? দু’জন বন্ধুকে ফোন করি, কিন্তু কেউই এই ঝড়-জলে বেরোতে রাজি নয়। অগত্যা উবের বুক করি, কিন্তু সেও ড্রাইভার পাওয়া যায় না, পেতে পেতে মিনিট ১৫ কেটে গেল। অল্প রাস্তা তায় নিশুতি রাত, হুশ করে পৌঁছে গেলাম। যা দেখলাম, তাকে আর যাই হোক বাড়ি বলা যায় না। মাথার ওপর একটা টালির চাল, চারদিক টিন দিয়ে ঘেরা, বাড়ি গোছের একটা কাঠামো কোনও মতে দাঁড় করানো। একটাই ঘর, সঙ্গে বারান্দা কাম রান্নাঘরের মতো এক চিলতে জায়গা। নোংরা, এঁটো কাটা ছড়ানো। ঘরে ঢুকেই দেখি নিচু তক্তোপোষের ওপরে এক বেঁহুশ মহিলা শুয়ে আছেন। একটা অক্সিমিটার তো দূর অস্ত বাড়িতে থার্মোমিটারটা পর্যন্ত নেই। গায়ে হাত দিয়ে দেখি, পুড়ে যাচ্ছে। দ্রুত থার্মোমিটার আর অক্সিমিটার বার করে চেক করতে শুরু করি। ১০৪ এর উপর জ্বর, আর অক্সিজেন স্যাচুরেশন প্রায় ৭৫-এর কাছাকাছি। ভাগ্য ভালো যে বুদ্ধি করে বাড়িতে থাকা অক্সিজেন সিলিন্ডারটি সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলাম।
দ্রুত অক্সিজেন চালু করে দিই। সঙ্গে সঙ্গে চলতে থাকে মোবাইলে ডাটা দেখে অ্যাম্বুল্যান্স আর হাসপাতালের খোঁজ। বরানগরের কাছে এক অ্যাম্বুল্যান্স চালককে ফোন করি। তিনি আসছেন বলে জানান। খোঁজ নিয়ে জানতে পারি বরানগর স্টেট জেনারেল, এবং বেলেঘাটা আইডিতে বেড ফাঁকা, কাছাকাছির মধ্যে এই দুটোই আছে। ঠিক করে নিই এই দুটোয় না পেলে হয় আরজি কর না হলে পরবর্তী টার্গেট এমআর বাঙ্গুর। ছেলেটিকে বলি একটা ব্যাগে মায়ের কয়েকটি পোশাক দিয়ে দিতে।
অক্সিজেন পেয়ে খিঁচুনি খানিকটা কমে ভদ্রমহিলার। অ্যাম্বুল্যান্সের অপেক্ষা শুরু হয়। প্রায় আধাঘণ্টা পরে যখন অ্যাম্বুল্যান্স আসে ততক্ষণে মহিলা অনেকটা ধাতস্থ। জ্বরটা আছে। অ্যাম্বুল্যান্স চালককে সবটা খুলে বলি এবং কোথায় কোথায় যাব সেটাও বলি। অনেকটা গাঁইগুঁই করতে করতে রাজি হয় সে। ভাড়া সাড়ে তিন হাজার, আর বাঙ্গুর পর্যন্ত গেলে সেটা আরও দেড় হাজার বেড়ে যাবে। উপায়ন্তর না দেখে তাতেই রাজি হয়ে যাই। ভদ্রমহিলাকে অ্যাম্বুল্যান্সে তুলে ছুটে যাই বরানগর স্টেট জেনারেলের দিকে। সঙ্গে ফোনে চলতে থাকে আমার দুই কোভিড যোদ্ধার সঙ্গে কো-অর্ডিনেশন। বরানগরে স্টেট জেনারেল হাসপাতালে পৌঁছে দেখি বেড নেই, এ বার গন্তব্য বেলেঘাটা আইডি।
সৌভাগ্যক্রমে সেখানে বেড পেয়ে যাই। এরপর ভদ্রমহিলাকে নিয়ে ভর্তির ফর্ম্যালিটি পূরণ করা হয়, অ্যাম্বুল্যান্সের চালককে বলি একটু অপেক্ষা করতে, সব ফর্ম্যালিটি পূর্ণ হলে তবেই তাকে টাকা দিয়ে ছাড়ব। প্রায় দেড় ঘণ্টা পর ভদ্রমহিলাকে বেডে দেওয়া হয়। ছেলেটিকে সব বুঝিয়ে দিই। বলি চিন্তার কিছু নেই, আমরা আছি, সব ঠিক হয়ে যাবে। ছেলেটি প্রায় হাত জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে, বলে দাদা আপনি না থাকলে…।
তাকে সামাল দিয়ে হাতে হাজার দুয়েক টাকা দিয়ে অ্যাম্বুল্যান্সের কাছে এসে দাঁড়াই। ভোর হয়ে এসেছে। একটা সিগারেট ধরিয়ে অ্যাম্বুল্যান্সের চালককেও একটা দিই। সিগারেট খেতে খেতে তাঁকে অনুরোধ করি যদি আমাকে একটু মতিঝিল পর্যন্ত পৌঁছে দেন। রাজি হয়ে যান চালক। তাঁকে সাড়ে তিন হাজার দিতে হলে ৫০০ টাকা বউয়ের কাছে হাত পেতে নিতে হবে, কারণ পকেটে পড়ে আর মাত্র তিন হাজার। অ্যাম্বুল্যান্সে আসতে আসতে আমার স্বভাব অনুযায়ী গল্প জুড়ি চালকের সঙ্গে। এই কোভিড সিচুয়েশনে তিনি আর তাঁর আর এক সঙ্গী পালা করে প্রায় ২৪ ঘণ্টাই অ্যাম্বুল্যান্স চালাচ্ছেন। তাঁর নিজের বাড়িতেও মা কোভিডে আক্রান্ত। রেড ভলান্টিয়ার্সরা অনেক সাহায্য করেছে ইত্যাদি ইত্যাদি। রাস্তা কমে আসে, বাইরে প্রচণ্ড বৃষ্টি আর হাওয়া।
অন্ধকারে রইনু পড়ে স্বপন মানি।
ঝড় যে তোমার জয়ধ্বজা তাই কি জানি!
সকালবেলা চেয়ে দেখি, দাঁড়িয়ে আছ তুমি এ কি,
ঘর-ভরা মোর শূন্যতারই বুকের 'পরে ॥
অ্যাম্বুল্যান্স এসে দাঁড়ায় মতিঝিলের বন্ধুধাম অ্যাপার্টমেন্টের সামনে। বৃষ্টির মধ্যেই নেমে দাঁড়িয়ে পকেট থেকে তিন হাজার টাকা বার করে অ্যাম্বুল্যান্স চালকের হাতে দিয়ে বলি, একটু দাঁড়ান আমি বাকি ৫০০ টাকা উপর থেকে নিয়ে আসছি। বলে অক্সিজেন সিলিন্ডারটি তুলে সিঁড়ির দিকে পা বাড়াই। হঠাৎ সেই চালকটি বলেন, ‘দাদা, আপনারা কাজ করছেন, ছেলেটির যা অবস্থা দেখলাম সব টাকা তো আপনাদেরই খরচা করতে হবে হবে। এই নিন…।’ বলেই দেড় হাজার টাকা আমায় ফিরিয়ে দেয়। আমি অবাক হয়ে তাঁর দিকে তাকাতেই বলেন, 'দাদা রোজ অ্যাম্বুল্যান্স চালিয়ে অনেক টাকাই তো রোজগার করছি। একটা পেশেন্ট তিনের জায়গায় দেড় হাজার দিলে ক্ষতি কিছু হবে না। বরং এই টাকাটা ওই ছেলেটার মায়ের ওষুধে লেগে যাবে। রেখে দিন। আর দরকারে লাগলে আবারও ফোন করবেন। আমার মাও তো অসুস্থ, প্রার্থনা করবেন যেন সুস্থ হয়ে যায়। আপনার কাছ থেকে টাকা নিলে নিজের কাছে মুখ দেখাতে পারব না।’ বলেই গাড়ি ঘুরিয়ে উল্টোদিকে ঝড়ের গতিতে এগিয়ে যায় ফাঁকা রাস্তায়। আমি ভিজতে থাকি বাড়ির গেটের সামনে দাঁড়িয়ে। ভিজতেই থাকি, শরীরে ও মনে। এই প্রথম ইয়াসের জন্য চিন্তা নয় বরং ভালো লাগছিল। অ্যাম্বুল্যান্স রাস্তায় মিলিয়ে যাওয়ার পর পা বাড়াই নিরাপদ আশ্রয়ের দিকে, আর মনে মনে বলতে থাকি সাবধানে যেও ভাই, সাবধানে, পূব আকাশে তখন নতুন দিনের রেখার অভাস।
এসো কর স্নান নবধারা জলে বলবে কে আর
শহরে বৃষ্টি জল কাদা মাখা নোংরা দেদার।
গীতবিতানের শুকনো পাতায় বর্ষার গান।
রবীন্দ্রনাথ একলা ভেজেন আমাকে ভেজান

	
							
Arts and Literature
Bioscope
Columns
Green Field
Health World
Interviews
Investigation
Live Life King Size
Man-Woman
Memoir
Mind Matters
News
No Harm Knowing
Personal History
Real Simple
Save to Live
Suman Nama
Today in History
Translation
Trivia
Who Why What How

