Wednesday, October 30, 2024

বসন্ত বিলাপ

Must read

বসন্ত বিলাপ

সুমন চট্টোপাধ্যায়

আজ থেকে ঠিক দশ বছর আগে তিউনিশিয়ার এক ছোট অখ্যাত শহরে একটি মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছিল!

বাজারে এক ফল-বিক্রেতার সঙ্গে পুলিশের বচসা বাধে। খেপে গিয়ে ওই পুলিশকর্মী ফল বিক্রতাকে সকলের সামনে একটা চড় মেরে তার ইলেকট্রনিক দাঁড়িপাল্লাটি কেড়ে নেয়। অপমান, লাঞ্ছনা হজম করতে না পেরে বেচারি সেখানে দাঁড়িয়েই গায়ে আগুন দিয়ে আত্মাহুতি দেয়।

চোখের নিমেষে ওই একটি স্ফুলিঙ্গ শাসক-বিরোধী দাবানলের চেহারা নিয়ে ছড়িয়ে পরে প্রথমে তিউনিশিয়ায়, তারপরে একে একে বেশ কয়েকটি প্রতিবেশী দেশে— লিবিয়া, ইয়েমেন, বাহারিন, সিরিয়া এবং মিশরে। একনায়ক শাসিত আরব দুনিয়ায় মুক্তি, গণতন্ত্র আর স্বাধীনতার পক্ষে উদ্বেলিত জনসমুদ্র দেখে বাকি বিশ্ব কোরাসে জয়ধ্বনি দিয়ে বলেছিল, আরবে বসন্ত এসে গেছে, আহা কী আনন্দ!

ভালো করে গায়ে হাওয়া লাগার আগেই বসন্ত চলে গিয়েছে। দশ বছর পরে পড়ে আছে তার বিষণ্ণ-মধুর স্মৃতি। লিবিয়া আর ইয়েমেন লাগাতার গৃহযুদ্ধের কারণে আজ ধ্বংসস্তূপ। মিশর, সিরিয়া আর বাহারিনে বিরোধিতার শেষ রেশটুকু পায়ের তলায় দলিয়ে দিয়ে মসনদে আসীন আবার সেই একনায়কেরাই। বসন্তের একমাত্র পলাশ হয়ে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাটা তিউনিশিয়া কোনও মতে টিকিয়ে রেখেছে, গভীর তমসার মধ্যে শিবরাত্রির শলতে যেন। যদিও তিউনিশিয়ার অর্থনীতির এমন বেহাল অবস্থা যে এই দেশটি সম্পর্কেও নিশ্চিত হয়ে কোনও ভবিষ্যদ্বাণী করা যাচ্ছে না।

আরব্য-রজনীর এমন রক্তে দোলা দেওয়া কাহিনি এত তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেল কেন? কোথায় ছিল দুর্বলতা? নাকি ভুলটা আমরাই করেছিলাম স্বপ্নকে বাস্তবের বিকল্প ধরে নিয়ে? ওটা কি তাহলে আদৌ বসন্ত ছিল না? তাহলে কী ছিল? রজ্জুতে সর্পভ্রম? মরীচিকাকে ছায়া সুনিবিড় জলাশয় ঠাওরানো?

মাত্রই দশ বছরের ব্যবধানে এত সব গূঢ় তত্ত্বের তল পাওয়া কঠিন, কার্যত অসম্ভব। এত সাম্প্রতিক ঘটনার বিচারে বসা ইতিহাসের কাজ নয়, তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে আরও অনেকদিন। আরব বসন্ত এখনও সাংবাদিকের চর্চার বিষয়, পশ্চিমী মিডিয়ায় তা নিরন্তর হয়েও চলেছে। বাংলা মিডিয়ায় অবশ্য এই সব আলোচনা খুঁজতে যাওয়া পণ্ডশ্রম, ওরা ব্যস্ত জাগতিক আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে। যেমন ধরুন শুভেন্দু-ভাইপোর সুললিত কবির লড়াই !

ব্যর্থতার উৎসে যেতে হলে ওয়াশিংটন হয়ে যেতেই হবে, কেননা আরব দুনিয়ার সব একনায়কই কম-বেশি আমেরিকার পোষ্য, মার্কিন সমর-সরঞ্জামের তারাই সবচেয়ে বড় বাজার। সুতরাং সঙ্গত ভাবে এ প্রশ্ন উঠেছে, ভবিষ্যতেও উঠবে যে শেষ বিচারে ওয়াশিংটনের নিস্পৃহতা বা দোদুল্যমান মনোভাবই কি শ্বাসরুদ্ধ করে দিল বাসন্তিকদের? গোটা দুনিয়াকে রোজ চারবার করে গণতন্ত্র আর ব্যক্তিস্বাধীনতার বাণী শোনানো গুরু-ঠাকুররা কি আরবে এসে অস্ট্রিচ পাখি হয়ে গেলেন?

প্রশ্ন উঠছে কেননা আরব বসন্ত চলাকালীন হোয়াইট হাউসের মালিক ছিলেন আমেরিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। সেই ওবামা যিনি সৌদি আরবে গিয়ে রাজাকে সরাসরি ভ্যর্ৎসনা করার হিম্মত দেখিয়েছিলেন। সেই ওবামা যিনি কায়রোর তাহরির স্কোয়ারে জনরোষের স্বতঃস্ফূর্ত বিস্ফোরণ দেখে ওয়াশিংটনের বিশ্বস্ত ভৃত্য মিশরের প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারককে পরামর্শ দিয়েছিলেন অবিলম্বে গদি ছাড়ার। সেই ওবামা তারপরে কেন চকিতে বদলে গেলেন? কোন বাধ্যবাধকতার কাছে নতি স্বীকার করতে হলো তাঁকে?

তাঁর ইয়া-মোটা আত্মজীবনীতে ওবামা নিজেই ঝোলা থেকে বেড়ালের মুখটি বের করে দেখিয়ে দিয়েছেন। ওবামা লিখেছেন, মুবারককে গদি ছাড়ার পরামর্শ দেওয়ার অব্যবহিত পরে সংযুক্ত আরব আমিরশাহির দণ্ডমুণ্ডের কর্তা শেখ মহম্মদ বিন জায়েদের ফোন আসে তাঁর কাছে। উত্তেজিত গলায়, কিছুটা ধমকের সুরেই তিনি ওবামাকে বলেন, ‘আমেরিকাকে আমরা আর নির্ভরযোগ্য বন্ধু বলে মনে করতে পারছি না।’

এ অনেকটা যেন নেংটি ইঁদুরের পশুরাজ সিংহকে শাসানোর মতো। একরত্তি দেশ সংযুক্ত আরব আমিরশাহি, আমেরিকার অস্ত্র আর প্রশিক্ষণে লালিত তাদের ফৌজ, তিনি কি না চোখ রাঙাচ্ছেন বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর দেশের প্রেসিডেন্টকে। বিচক্ষণ ওবামা বুঝে গেলেন সঙ্কেতটা কী! তিনি লিখেছেন, ‘ It was a warning that the old order had no intention of conceding power without a fight.’

তারপরে যা হল তা পাল্টি খাওয়ার উলট পুরাণ। ২০১৩ সালে মুসলিম ব্রাদারহুডের নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে মিশরের সেনাবাহিনী যখন গায়ের জোরে ক্ষমতা দখল করে নিল, ওবামা প্রশাসন তাকে ‘অভ্যুত্থান’ বলতে অস্বীকার করল। লিবিয়ায় গদ্দাফির মৃত্যুর পরে দেশটাকে গৃহযুদ্ধের মাঝখানে ফেলে দিয়ে সরে দাঁড়াল আমেরিকা। সৌদি আরব এই যে ইয়েমনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়েই যাচ্ছে, লাখ লাখ নিরীহ মানুষের মৃত্যু হচ্ছে, সেখানেও রাজতন্ত্রের দোসর আমেরিকা। নির্বাচিত হওয়ার পরে নতুন মার্কিন প্রেসিডন্ট বিডেন বলেছেন, ইয়েমেনর বিরুদ্ধে যুদ্ধে সৌদি আরবকে আমেরিকা আর মদত দেবেনা। সর্বনাশের মাথায় বাড়ি পড়ে যাওয়ার পরে এই উপলব্ধির গুরুত্ব কতটুকু?

আমেরিকার পশ্চাদপসারণের সুযোগ নিতে বাকিরা দেরি করেনি-ইরান, রাশিয়া, তুরস্ক, সৌদি আরব, আমিরশাহি যে যার মতো করে এ তল্লাটে নিজেদের প্রভাব আরও অনেক বাড়িয়ে নিয়েছে। বাহারিনে ফৌজি ট্যাঙ্ক পাঠিয়ে সৌদি আরব রাজাকে বাঁচিয়েছে সংখ্যাগুরু শিয়াদের বিদ্রোহ অঙ্কুরেই বিনাশ করে দিয়ে। গৃহযুদ্ধ, ইসলামিক স্টেট সব কিছুর মোকাবিলা করে রাশিয়া আর ইরানের প্রত্যক্ষ মদতে এখনও সে দেশের প্রেসিডেন্টের নাম বাশার-আল-আসাদ। নটে গাছটি মুড়োলে অতএব আরব বসন্তের আগে পরিস্থিতি যে তিমিরে ছিল, এখন তার চেয়েও ঘন অন্ধকার। মাঝখান থেকে এতগুলি দেশ ভেঙেচুরে তছনছ হয়ে গিয়েছে, আমজনতার দুরবস্থা অবর্ণনীয়।

তাহলে কি বসন্তরাগ আরব দুনিয়ায় চিরতরে স্তব্ধ হয়ে গেল? রাজতন্ত্রের শোষণই হয়ে থাকবে এ তল্লাটের ভবিতব্য? গণতন্ত্রের আন্দোলনে সে দিন যারা স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে যোগ দিয়েছিল, তারা বেশিরভাগই আজ দিগ্‌ভ্রান্ত, হতাশ। আরব বসন্তের ব্যর্থতার কারণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে একজন চমৎকার বলেছেন, ‘সবচেয়ে বড় শিক্ষাটা হলো, কেউ আমাদের সাহায্য করবে না। নিজেদের লড়াইটা নিজেদেরই লড়তে হবে। সাহায্যের জন্য আমরা যে সব দেশের দিকে তাকিয়েছিলাম, তারা সমাধান নয়, সমস্যারই অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।’ আর একজনের মন্তব্য, ‘আমরা ছিলাম অপরিণত। সংঘর্ষ কাকে বলে, গণতন্ত্র বস্তুটা কী, রাজনীতি বলতে কী বোঝায়, কিছুই আমরা বুঝতাম না। এখন অবশ্য সকলেই কম বেশি বুঝেছেন, পুরোনো ব্যবস্থার রক্ষকেরা সবদিক থেকে তাদের চেয়ে শক্তিশালী।’ মৌরসিপাট্টা বজায় রাখার কায়েমী স্বার্থে তারা ঐক্যবদ্ধ। লড়াইটা তাই যেন ডেভিড বনাম গলিয়াথের।

ব্যর্থ হয়েছেন তবু স্বপ্ন দেখা ছাড়েননি এমনও অনেকে আছেন। ইয়েমেনের জনজাগরণে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য ২০১১ সালে তারাক্কুল কারমান নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। তাঁর স্পষ্ট কথা, ‘যাঁরা মনে করছেন আরব বসন্ত কবরে চলে গিয়েছে, মানুষের আন্দোলনের ইতিহাস তাঁরা জানেন না। আমাদের স্বপ্ন মরেনি, কোনও দিন মরবেও না।’

- Advertisement -spot_img

More articles

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisement -spot_img

Latest article