33 C
Kolkata
Friday, October 18, 2024

স্ট্যাচু অফ লিবার্টি পাড়ি দিল আমেরিকায়

Must read

নিজস্ব প্রতিবেদন: এক্কেবারে অপ্রত্যাশিত দুর্দান্ত এক উপহার পেতে চলেছেন নিউইয়র্কের মানুষ। লিবার্টি দ্বীপে অবস্থিত বিশ্বখ্যাত স্ট্যাচু অফ লিবার্টির একটি অনুকৃতি আগামী স্বাধীনতা দিবসে তাঁদের উপহার দিতে চলেছে ফ্রান্স। আকৃতিতে মূল স্ট্যাচুটির এক-ষোড়শাংশ ব্রোঞ্জনির্মিত এই স্ট্যাচুটি। প্যারিসের ন্যাশনাল মিউজিয়াম অফ আর্ট অ্যান্ড ক্রাফটস (সিএনএএম)-স্থিত উদ্যানে ২০১১ সালে স্থাপন করা হয়েছিল ‘কনিষ্টা’ স্ট্যাচুটিকে। এতদিন সেখানে থাকার পর গত সোমবার এক বিশেষ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে তাকে সেখান থেকে উঠিয়ে যত্নসহকারে বাক্সবন্দি করা হয়। ১ থেকে ৫ জুলাইয়ের মধ্যে এই প্রতিরূপটিকে বসানো হবে এলিস দ্বীপে, আদত মূর্তিটি যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, তার অপর পারে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ১৯৪৪-এর যে বিশেষ দিনে আমেরিকা ও অন্যান্য মিত্র শক্তির সেনাবাহিনী ফ্রান্সের মাটিতে অবতরণ করেছিল, যার মধ্য দিয়ে ঘোষিত হয়েছিল নাৎসি শাসনের করালগ্রাস থেকে পশ্চিম ইউরোপের মুক্তির তূর্যনাদ, তার ৭৭ তম বর্ষপূর্তির অব্যবহিত পরের সময়টিকে এই মূর্তি স্থাপনের প্রতীকী ক্ষণ হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে। ৪ জুলাই, আমেরিকার স্বাধীনতা দিবসের পর পরই আসে আরএকটি ঐতিহাসিক দিন, বাস্তিল দিবস, তারিখ ১৪ জুলাই। সেই দিনটিতেই ওয়াশিংটন ডিসি-তে ফরাসি দূতাবাসের বাইরে স্থাপিত হবে এই কনিষ্ঠা স্ট্যাচু অফ লিবার্টি। দৈর্ঘ্যে ১০ ফিট, ওজন ৪৫০ কিলোগ্রামের ওপর এ স্ট্যাচুটির নির্মাণ শুরু হয় ২০০৯ সালে। মূল স্ট্যাচুটির যে অবিকল প্লাস্টার-নির্মিত প্রতিরূপ ১৮৭৮ থেকে সিএনএএম-এ সংরক্ষিত আছে, এটি তারই অনুকৃতি।

এ প্রসঙ্গে সিএনএমএ-র সাধারণ প্রশাসক অলিভিয়ের ফেরঁ-র মন্তব্যটি প্রণিধানযোগ্য। ‘এই মূর্তিটি মুক্তির প্রতীক, আলোরও। এর মধ্য দিয়ে আমরা খুব আন্তরিক এক বার্তা পৌঁছে দিতে চেয়েছি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে। এই মুহূর্তে আমাদের পারস্পরিক সৌহার্দ্যটি খুব মূল্যবান আমাদের কাছে। এই মৈত্রী আমরা সযত্নে রক্ষা করতে আগ্রহী।’

রোমান পুরাণে স্বাধীনতার দেবী ছিলেন লিবার্টাস। সেই লিবার্টাসের আদলে, নিও- ক্লাসিক্যাল রীতিতে নির্মিত নিউইয়র্ক-স্থিত স্ট্যাচু অফ লিবার্টি। ১৫১ ফুট দৈর্ঘ্যের এই মূর্তি এক অতিকায় বেদীর ওপর বসানো এবং আপাদমস্তক ব্যঞ্জনা-রঞ্জিত। মুকুটের সাতটি ফলা, যেন এ বসুন্ধরাকে আলোকিত করা সাত-রঙা সূর্যালোক। আমেরিকার স্বাধীনতার তারিখটি রোমান অক্ষরে খোদাই করা আছে একটি ফলকের ওপর। দাসপ্রথার বিলোপের প্রতীক হিসেবে বাঁ পায়ের নীচে পড়ে আছে ছিন্নবিচ্ছিন্ন শৃঙ্খল। ফরাসি ইতিহাসবিদ আঁদ্রে ক্যাস্পি এই মূর্তি উন্মোচন অনুষ্ঠানে যে ভাষণ দেন, তাতে তিনি বলেন যে, প্যারিস ও ওয়াশিংটনের মধ্যে কূটনৈতিক দূরত্ব যখন ক্রমেই বেড়ে চলছিল, এমন একটা সময়ে, ১৮৮৬ সালে, নিউইয়র্কে পৌঁছোয় ধ্রুপদী এই ভাস্কর্যটি, ফ্রান্স-মার্কিন সৌহার্দ্য-অভীপ্সার স্মারক-স্বরূপ।

আরএক ফরাসি ইতিহাসবিদ এদুয়ার্দ দ্য ল্যাবিউলে গৃহযুদ্ধ-উত্তর নবোদ্ভিন্ন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি উপহারস্বরূপ প্রথম স্ট্যাচু অফ লিবার্টি নির্মাণের প্রস্তাব দেন ১৮৬৫ সালে। ল্যাবিউলে আমেরিকার ক্রীতদাস-প্রথা বিলোপকে দেখতেন ফরাসি নবচেতনা-সঞ্জাত মূল্যবোধের প্রেক্ষিতে। ফ্রান্স সে সময়ে নানারকম ঐতিহাসিক উথাল-পাথালের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। ১৮৭০ সালে ফ্রাঙ্কো-প্রুশ যুদ্ধের মধ্য দিয়ে সবে অত্যাচারী সম্রাট তৃতীয় নেপোলিয়নের শাসনের পরিসমাপ্তি ঘটেছে। পরের বছর, ফ্রান্স তখন তৃতীয় প্রজাতন্ত্রের অধীনে, ফ্রেডরিক অগাস্ত বার্থোলদি-কে নির্বাচন করা হল এই ভাস্কর্যটি নির্মাণের জন্য। বার্থোলদি অতলান্তিক সমুদ্র পেরিয়ে আমেরিকার উদ্দেশে যাত্রা করলেন। উদ্দেশ্য দ্বিবিধ, প্রশাসনের সঙ্গে নির্মাণ-প্রকল্পটি নিয়ে আলোচনা এবং সম্ভাব্য নির্মাণ-স্থল নির্বাচন।

বিগত সেনাপ্রধান ও তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রপতি ইউলিসিস এস গ্রান্ট প্রাথমিক ভাবে এই প্রকল্পটি সম্পর্কে খুব বেশি উৎসাহ দেখাননি বলেই জানা যায় আঁদ্রে ক্যাস্পির লেখায়। সে সময়ে নিউইয়র্ক-গামী সমস্ত জাহাজ বেডলো’জ দ্বীপকে ছুঁয়ে যেত, বার্থোলদি তাই এই দ্বীপটিকেই মূর্তি নির্মাণের আদর্শ জায়গা হিসেবে নজরে রেখেছিলেন প্রথম থেকেই, যদিও ১৮৭৫ সালের আগে রাষ্ট্রপতি গ্রান্টের কাছে রীতিমাফিক অনুরোধটি করে উঠতে পারেননি। সেই বেডলো’জ দ্বীপই আজকের লিবার্টি দ্বীপ। স্থান নির্বাচন তো হল, কিন্তু এই বিপুল ব্যয়ভার বহন করবে কে? দু’টি দেশের মধ্যে চুক্তি হল, মূর্তি নির্মাণের খরচ দেবে ফ্রান্স, সেই মূর্তি স্থাপিত হবে যে বেদীর উপর তার ব্যয় বহন করবে আমেরিকা।

ভাস্কর্য নির্মাণে বার্থোলদির সময় লেগেছিল প্রায় একটি গোটা দশক। লোহার কাঠামোর ওপর তামার ফলক বসিয়ে তৈরি হয়েছিল এই মূর্তি। অবয়ব-ভাবনার মূল কৃতিত্ব ফরাসি বাস্তুকার ইউজিন ইম্যানুয়েল ভায়োলেট লে দ্যু-র। ১৮৭৯-এ তিনি প্রয়াত হলে আইফেল টাওয়ার নির্মাণের জন্য খ্যাত আরএক ফরাসি বাস্তুকার আলেক্সান্দ্রে গুস্তাভ আইফেল তাঁর অসম্পূর্ণ কাজটি সম্পন্ন করেন।

মূর্তিটির অংশসমূহ বিচ্ছিন্ন করে একটি জাহাজে চাপিয়ে নিয়ে আসা হয় নিউইয়র্কে। পরের বছর, নবনিযুক্ত রাষ্ট্রপ্রধান গ্রোভার ক্লিভল্যান্ড স্ট্যাচু অফ লিবার্টির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করে বার্থোলদি-কে তৎকালীন আমেরিকার মহত্তম মানুষের শিরোপা দেন।

শতাব্দী-অধিক অতিক্রান্ত। সিএনএএম এবং ফারোঁ কর্মশালার মাধ্যমে স্থানীয় ভাবে নির্বাচন করে ফ্রান্সের উৎকৃষ্টতম কারিগরদের নিযুক্ত করেছেন আধুনিক প্রতিরূপটি নির্মাণে। যেন অতীত ঐতিহ্য ক্ষুণ্ণ না হয়, বার্থোলদি-র কারুকৃতির অপমান না হয় কোনওমতেই। পাঁচ জন শিল্পী মিলে ম্যালাকফ-এর স্যুসে ফন্দেয়ার নামক শৈল্পিক নির্মাণালয়ে টানা চারমাস পরিশ্রম করে মূর্তিটিকে সাকার করে তোলেন।

মূল স্ট্যাচুটির যাত্রাপথটিকে অনুকরণ করা হবে কনিষ্ঠার ক্ষেত্রেও। ১৯ জুন লা হার্ভে বন্দর থেকে জাহাজবাহী হয়ে রওনা দেবে সে। নিউইয়র্ক পৌঁছবে ১ জুলাই। চূড়ান্ত গন্তব্য ওয়াশিংটন ডিসি। সেখানে ফরাসি রাষ্ট্রদূতের নিবাসে প্রদর্শিত হতে থাকবে মূর্তিটি আগামী দশ বছর ধরে, সারা পৃথিবীর শিল্পমোদী ও ইতিহাসপ্রেমী দর্শকদের জন্য।

- Advertisement -

More articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisement -

Latest article