Sunday, September 8, 2024
Home Arts and Literature রবিনাথের জন্ম না হলে

রবিনাথের জন্ম না হলে

আমার যা হতো বা হতো না

নির্ঝর নৈঃশব্দ্য

এর আগে আমি কখনই ভাবি নাই রবিনাথের জন্ম না হলে কী হতো! ও আচ্ছা, কথা শুরুর সঙ্গে বলে নিই — আমি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে রবিনাথ বলে ডাকি, আর লিখি। অনেকেই মানতে পারেন না। কেন ডাকি? ঠাকুর আর নাথ তো একই কথা। লোকে তাকে রবিঠাকুর ডাকতে পারলে আমি রবিনাথ কেন ডাকতে পারব না? আর আমার ভালোবাসার মানুষকে আমি ভালোবেসে যা ইচ্ছা তা ডাকবো। তার সমালোচনা করব, তাকে গালি দিব, তার সঙ্গে ঝগড়া করব, আপোস করব। তাকে ধরে কামড়ে দেব। 

শৈশব থেকেই দেখছি আমি আমার কোনও বেদনার কথা, স্বপ্নের কথা, প্রেম ও শূন্যতার কথা, বিষাদ, আশা বা হত-আশা, রং ও রংধনুর কথা, রতি ও আরতির কথা, নিজেকে সান্ত্বনা দেওয়ার কথা, আরও আরও রক্তের ভিতরকার কথা, শিরা ও ধমনীর ভিতরকার দ্রুত ও বিলম্বিত লয়ে বিস্তারিত কম্পনের কথা কারও কাছে বা কোনও হাওয়ার কাছে, বা নদীর কাছে, স্রোতের কাছে, ধানক্ষেত, প্রান্তর ও তেপান্তরের কাছে, চোখভর্তি টলটলে দুটো পুকুর বা দিঘি নিয়ে মেঠোপথে উদাস দাঁড়িয়ে থাকা অনাথ গরুবাছুরটির কাছে, পাহাড় বা ভোরের কাছে, সমুদ্র বা নাবিকের কাছে, মাছের কাছে বা একটি সবুজ হাঁসের কাছে, একটি গাছের কাছে, তার একটি ঝরাপাতার কাছে, একটি মন খারাপ করা ফলের কাছে বা কারও কাছে, কিংবা না-কারও কাছে আরও আরও কিছু, আরও কারও কাছে কোনও ভাবে প্রকাশ করতে গেলেই কোনও না কোনও ভাবে রবিনাথের লিখে যাওয়া কথাই প্রকট হয়। হয়তো অন্য ভাবে বলি কিন্তু ভাবটা তারই জেনে মনের মধ্যে কেবল না-পারার বেদনা একটুখানি কেঁপে থেমে যায়। সকলেরও নিশ্চয় আমার মতোই কাঁপে বুকে ব্যর্থতার ফুল। আর মনে মনে বলে ‘বাজলো বুকে সুখের মতো ব্যথা…’ রবিনাথের জন্ম না হলে এমন কেমন করে হতো? 

‘সুন্দর, তুমি চক্ষু ভরিয়া. এনেছ অশ্রুজল। এনেছ তোমার বক্ষে ধরিয়া. দুঃসহ হোমানল’ … এইসব পঙ্ক্তি আমার রক্তের ভিতর প্রথম দাগ কাটে সেই শৈশবে। যখন সেই প্রাইমারি ইশকুলে থাকতে বাবার বুকশেল্ফ থেকে নামিয়ে শেষের কবিতা পড়ি। তারপর থেকে আমি সেই সুন্দর নিজের ভিতর নির্মাণ করি। রবিনাথ আমাকে এইভাবে বছরের পর বছর ধরে সুন্দর করে তোলেন। তিনি না থাকলে এই যে সুন্দর হওয়ার পথ, সেই পথের সন্ধান আমি হয়তো কারও কাছেই পেতাম না।

রোদ আর জোছনার মধ্যবর্তী রূপের যে অপরূপ রূপকথা তা আমি রবিনাথের মধ্যে পেয়েছি। তিনি না থাকলে এই ভাষাতীত সৌন্দর্যের কোনও প্রকাশই আমি কখনও করতে পারতাম না।

আমার জীবনে রবিনাথের অবদান জোছনা, বৃষ্টি আর প্রেম। রবিনাথের জন্ম না হলে আমার কাছে বৃষ্টি অন্য রকম হতো, জোছনা অন্য রকম হতো, প্রেম অন্য রকম হতো। 

আমি গীতবিতানের মধ্য দিয়ে এই তিনকে ধরেছি আমার রক্তের ভিতর। তার মানে রবিনাথের জন্ম না হলে গীতবিতানের জন্ম হতো না। আর গীতবিতান আমার চির হিরণ্ময় আশ্রয়।

রবিনাথের জন্ম না হলে আমি হয়তো মেঘদূত থেকে বৃষ্টি নিতাম। কিংবা অন্য আর এগারোজনের মতো আমিও বৃষ্টির ভিতর ছাতা বা বর্ষাতি নিয়ে হেঁটে যেতাম। বৃষ্টির নিষ্ঠুরতার পাশে তার সৌন্দর্যকে গায়ে মাখতে পারতাম না। তার মানে রবিনাথের কারণেই জন্মাবধি আমার ছাতা নেই, জন্মাবধি আমি বৃষ্টিতে ভিজে যাই। 

রবিনাথের জন্ম না হলে আমি হয়তো বুদ্ধের কাছ থেকে জোছনা নিতাম, সেই গৃহত্যাগী জোছনা। কিন্তু সেই জোছনা ছাড়তে বলে ঘর, ছাড়তে বলে সংসার। সেই জোছনা জানে কেবল সন্ন্যাস। কিন্তু রবিনাথ যে জোছনা আমাকে দিল, সেই জোছনা ঘর আর বাহির একাকার করে করে জুড়ে দেয়। শরীরকে ঘরে রেখে মনটাকে বাহিরে ছোটায়। ‘তুমি আমার মুক্তি হয়ে এলে বাঁধনরূপে…’। বাঁধন হল সংসার, বাঁধন মানে শৃঙ্খলা এইখানে। এইখানে তিনি স্বাধীনতা আর স্বেচ্ছাচারিতার ভেদ টেনেছেন। শৃঙ্খলার বাঁধন কবি বা সন্ন্যাসী, সবার আছে। সেই বাঁধন আছে বলেই মুক্তি আছে। তবে সন্ন্যাস আর সংসারের শৃঙ্খলার মধ্যেও ভেদ আছে। সংসারের শৃঙ্খলা সন্ন্যাসের শৃঙ্খলার চেয়ে কঠিন। কিন্তু সংসারই সকলে মেনে নিতে চায়—সন্ন্যাসের শৃঙ্খলাকে নিতে চায় না। মানুষ তো আসলে সর্বংসহা নয়। সংসারের শৃঙ্খলা না বুঝেই মানুষ সংসার গ্রহণ করে। আর সন্ন্যাস সবাই গ্রহণ করলে প্রকৃতির যে-শৃঙ্খলা সেইটা ব্যাহত হবে। সন্ন্যাস গ্রহণের দরকারও নেই সকলের। সংসারের শৃঙ্খলা নিয়েই শেষের কবিতায় স্বপ্ন আঁকা হয়েছিল। সেই স্বপ্ন রবিনাথ সফল করতে দেন নাই। সেটা সফল হলে তো সংসারেরও সমাধান হয়ে গেল। স্বপ্নকে স্বপের ভিতর রেখেই দিয়েই সংসারকে নিরন্তর করে গেলেন। রবিনাথের জন্ম না হলে একই সঙ্গে সংসারী ও সন্ন্যাসী কেমন করে হতে হয় তা আমরা অনেকেই জানতে পারতাম না।

রবিনাথের জন্ম না হলে প্রেমের ভিতর আমি কখনই হয়তো সন্ধান করতাম না আনন্দের উৎসার। নিজেকে মনে হতো না আনন্দের সন্তান, আনন্দের সন্ধানই আমার একমাত্র কাজ। পূজা আর প্রেমের মধ্যে বিভেদ ঘুচিয়ে দিয়েছিলেন রবিনাথ। তার জন্ম না হলে ভক্তি আর ভয়ের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতে হতো, প্রার্থনার ভাষা হয়ে উঠত না ভালোবাসা। 

আমার চরম দুর্দিন আর অস্থির সময়ে রবিনাথের গান আমাকে মায়ের মতো আশ্রয় দেয়। এমনকী আমার মতো অবিশ্বাসীর মনও কখনও সখনও দ্রবীভূত হয় তার গান শুনলে পার্থিব অপার্থিব সবকিছু বিশ্বাস করতে মন করে। যখন শুনি ‘আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণধূলার তলে…’ তখন আমার ভিতর সব নুয়ে পড়ে, মাথা নত হয়ে যায় যেন বা মহান শূন্যতার কাছে। শূন্যতাই তখন পূর্ণতার রূপ হয়ে আমাকে আবিষ্ট করে রাখে। তিনি না থাকলে এমন কেমন করে হতো আমি কখনো ভাবতে পারি না।

আকাশ ও মাটির মধ্যকার যা কিছু সুন্দর আর ইন্দ্রিয়ের ভোগ আর উপভোগযোগ্য, সবই আমি রবিনাথের চোখের ভিতর দিয়ে দেখে তারপর নিজের চোখে দেখি আমার এমনই মনে হয়।

নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ কবিতা পড়তে পড়তে বাবা আমার নাম রাখলেন নির্ঝর। তার মানে রবিনাথের জন্ম না হলে আমারও জন্ম হতো না।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -

Most Popular

Recent Comments

রোশনী মুখোপাধ্যায় on ফেয়ার অ্যান্ড লাভলির দেশ
অভিষেক মল্লিক on এবার দ্যাখ কেমন লাগে
Anupam Bhattacharyya on ব্রাজিল! (২)
অভিষেক মল্লিক on ওরে বাবা ব্রাজিল!
Partha Chakraborty on নীল সামুরাই
Manju Bhattacharjee on আমার জম্মোদিন
শুভাশীষ কবীর আইচ। on আমার জম্মোদিন
নবনীতা বসু হক on আমার জম্মোদিন
নীলার্ণব চক্রবর্তী on আমার জম্মোদিন
রোশনী মুখোপাধ্যায় on আমার জম্মোদিন
শুভাশিস ঘোষ on এ সত‍্য সকলি সত‍্য
শুভ্রেন্দু রায় on মহারাজ একী সাজ হে
কৌশিক শীট। on মহারাজ একী সাজ হে
মিহির গাংগুলী on মহারাজ একী সাজ হে
তাপস কুমার পাল on মহারাজ একী সাজ হে
অপূর্ব গঙ্গোপাধ্যায় on মহারাজ একী সাজ হে
শুভাশীষ কবীর আইচ। on মহারাজ একী সাজ হে
কল্যাণ সেনগুপ্ত on আহত পুতিন আরও বিপজ্জনক
অপূর্ব গঙ্গোপাধ্যায় on কী খাবে জানি, কী খাওয়া উচিত জানিনা
অপূর্ব গঙ্গোপাধ্যায় on রাণী গেলেন, অতঃকিম?
siddhartha ghosh on বসন্ত বিলাপ
Sanghamitra Roychowdhury on হাদি থেকে জেহাদি