Sunday, September 8, 2024
Home News ফের আঙুল উঠছে চিনের দিকে

ফের আঙুল উঠছে চিনের দিকে

ফের আঙুল উঠছে চিনের দিকে

নিজস্ব প্রতিবেদন: মাঝখানে বিতর্কটি একেবারেই ধামাচাপা পড়ে গিয়েছিল, কেউ আর তেমন উচ্চবাচ্যই করছিলেন না। প্ররোচনা কোত্থেকে এল বুঝতে পারছি না, দেখতে পারছি কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউয়ের মতো এই ভাইরাসের উৎস সন্ধানে চিনা ষড়যন্ত্রের তত্ত্বটি ফের সংক্রামক হতে শুরু করেছে, মার্কিন মিডিয়ায় তা নিয়ে আলোচনাও হচ্ছে নিরন্তর।

নয়া উদ্যোগে ঘৃতাহুতি দিয়েছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের একটি নাটকীয় সিদ্ধান্ত। সিআইএ-সহ দেশের সব ক’টি গোয়েন্দা সংস্থাকে তিনি আদেশ দিয়েছেন, কোভিডের উৎস সন্ধানে তৎপরতা দ্বিগুণ করতে হবে এবং তদন্তের ফলাফল কী দাঁড়াল ৯০ দিনের মধ্যে তাঁকে তা জানাতে হবে। মার্কিন প্রেসিডেন্টরা সচরাচর গোয়েন্দাদের কাজকর্মে প্রকাশ্যে নিজেদের জড়াতে চান না। বিডেন সচেতন ভাবে সেই প্রথা থেকে সরে আসায় আরও বেশি চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে।

অতিমারি শুরু হওয়ার অব্যবহিত পরে কোভিডের উৎস সম্পর্কে মোটামুটি দু’টি তত্ত্ব আমরা শুনে আসছি। প্রথমটি হল, আর পাঁচটা ভাইরাসের মতো কোভিডও পশু থেক মানুষের দেহে সংক্রামিত হয়েছে। দ্বিতীয়টি হল, না তা নয়, চিনের উহানের কোনও গবেষণাগার থেকেই এই ভাইরাস ‘লিক’ হয়ে গোটা দুনিয়া জুড়ে প্রাণঘাতী তাণ্ডব চালাচ্ছে। দ্বিতীয় তত্ত্বটির মূল প্রবক্তা ছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম এবং তাঁর ঘোর দক্ষিণপন্থী সাঙ্গপাঙ্গকুল। কিন্তু বিজ্ঞানী মহলে চিনা ভাইরাসের তত্ত্ব একেবারেই আমল পায়নি। তাঁরা ভাইরাস লিক হওয়ার তত্ত্বকে পাগলের প্রলাপ বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন।

অতএব প্রশ্ন, হঠাৎ কী এমন হল যে কবরে চলে যাওয়া একটি তত্ত্বের কঙ্কালকে ফের বাইরে তুলে এনে কাটাছেঁড়া করতে হচ্ছে? নীচে রইল সেই সব প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন ও তাদের উত্তর।

করোনার জন্ম গবেষণাগারেই?

গোপন গবেষণার সুরক্ষাবলয়ে ফাটল, নাকি বাদুড় কিংবা প্যাঙ্গোলিনের দেহে ঘাপটি মারা ভাইরাসের বিবর্তন? কোভিডের উৎস সম্পর্কিত বিতর্ক ফিরে এল নতুন মাত্রা নিয়ে। উহানের গবেষণাগার থেকেই ভুলক্রমে ছড়িয়ে গেছে ভাইরাস, এক বছর আগেও এই দাবি মানতে নারাজ ছিলেন বিজ্ঞানীরা। আজ কিন্তু তাঁদের অনেকেই মত বদলাচ্ছেন। কোভিডের উৎস নিয়ে পূর্ণাঙ্গ, নিরপেক্ষ ও আন্তর্জাতিক তদন্তের দাবি তুলছেন। কী এমন ঘটল এর মাঝে?

মত বদল

সময়টা গত বছরের গোড়ার দিক। করোনা তখন সবে অতিমারীর চেহারা নিতে শুরু করছে। নিউমোনিয়া জাতীয় মারণ ব্যাধি, যার মূলে আছে চিন থেকে ছড়িয়ে পড়া একটা ভাইরাস, এর বাইরে বিশেষ কিছু জানা নেই কারওর। কিন্তু ভাইরাসের উৎস নিয়ে উঠে আসছে তত্ত্ব, পাল্টা তত্ত্ব। একদিকে ট্রাম্প প্রশাসনের গোয়েন্দা বিভাগ, অন্যদিকে বিশ্বের তাবড় ভাইরাস ও মহামারী বিশেষজ্ঞরা। শেষ পর্যন্ত ‘স্পিলওভার’ বা মনুষ্যেতর প্রাণী থেকে মানুষের দেহে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনাই মান্যতা পায়। কারণ, উল্টোদিকে ষড়যন্ত্র তত্ত্বের গন্ধ যতটা জোরালো ছিল, প্রমাণ ততটা নয়।

অন্য কোনো প্রাণী থেকে মানুষের দেহে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার উদাহরণ জিন বিজ্ঞানের ইতিহাসে ভুরিভুরি। বেশির ভাগ সময়েই সংক্রমণ বিরাট আকার নেয় না। কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভাইরাস মানুষের শরীরে ঢোকার আগেই এমন কোনো প্রাণিকোষে একটা লম্বা সময় কাটিয়ে ফেলে, যার সঙ্গে মানবদেহের কোষের গঠনে মিল আছে। আর তার ফলে সেই ভাইরাস অনেক বেশি শক্তিশালী আর বিপজ্জনক হয়ে ওঠার সুযোগ পেয়ে যায়। মধ্যযুগের বিউবনিক প্লেগ থেকে হালের এবোলা তার উদাহরণ। কোভিডের ভাইরাস সার্স কোভ-টু সেই চেনা ছকেই হানা দিয়েছে বলে প্রাথমিক ভাবে মনে করেছিলেন জীববিজ্ঞানী ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। এখনও যে সেই তত্ত্ব থেকে তাঁরা সরে আসছেন তা নয়, কিন্তু ‘ল্যাব লিক’ বা গবেষণাগার থেকে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনাকে আর আগের মতো এক ফুঁয়ে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।

খটকা কোথায়

সন্দেহের কারণ অনেক। তার মধ্যে প্রধান হল উহানের সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য নিয়ে চিনের বাড়াবাড়ি রকমের গোপনীয়তা এবং উহানের ভাইরোলজি ল্যাবের প্রধান ডক্টর শি ঝে লি-এর কাজ সম্পর্কে ফাঁস হওয়া কিছু তথ্য।

একেবারে শুরুর দিনগুলো থেকেই ষড়যন্ত্র তত্ত্বের সমর্থকদের নিশানায় ছিল উহান ইনস্টিটিউট অফ ভাইরোলজি। গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে ওই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত বিজ্ঞানীরা জানান, তাঁদের ফ্রিজারে সত্যিই এমন একটি ভাইরাস ছিল, যার সঙ্গে সার্স কোভ টু-র গঠনে মিল প্রায় ৯৬ শতাংশ। কিন্তু আন্তর্জাতিক অণুজীব বিশেষজ্ঞরা তার ভিত্তিতে দুয়ে দুয়ে চার করতে চাননি। তাঁদের মত ছিল, এ ক্ষেত্রে চার শতাংশ অমিল মানেও বিস্তর ফারাক। কারণ, করোনা ভাইরাসের প্রজাতিগুলি যে গতিতে নিজেদের জিনের গঠন বদলায়, তাতে ওই চার শতাংশের ফারাক হতে প্রায় ৪০ বছর লাগার কথা। অন্য দিকে, যে ভাবে সার্স কোভ-টু মানুষের দেহকোষের সঙ্গে নিজেকে জুড়ে নেয় এবং তারপর যে পদ্ধতিতে আক্রান্ত কোষের ভিতরে নিজের আরএনএ ঢুকিয়ে দেয়, তাতেও উহানে সংরক্ষিত ভাইরাসের সঙ্গে কোভিড ভাইরাসের বিশেষ সাদৃশ্য নেই, বরং কিছু কিছু স্তন্যপায়ীর দেহে পাওয়া ভাইরাসের সঙ্গে তার যথেষ্ট মিল। অর্থাৎ, চেহারা এবং চরিত্র, দুয়েতেই গবেষণাগারে থাকা ভাইরাসের সঙ্গে কোভিড ভাইরাসের তফাত রয়েছে। এই কারণেই ‘ল্যাব লিক’-এর বদলে ‘জুনটিক স্পিলওভার’ তত্ত্বে জোর দেন বিশেষজ্ঞরা।

অথচ, তার পরেও চিন উহানের ওই গবেষণাগারের কোনো নথি বা অভ্যন্তরীণ তদন্তের ফলাফল খোলসা করছে না এবং আন্তর্জাতিক অনুসন্ধানেও তাদের অনীহা। একদিকে নিজের দেশে অতিমারী সঙ্কট মোকাবিলার চাপ, আর অন্য দিকে ট্রাম্প প্রশাসনের উদ্ধত খবরদারিকে যদি শুরুর দিকে বেজিংয়ের অনড় মনোভাবের পিছনে যুক্তি হিসেবে খাড়া করাও যায়, দেড় বছর পরেও কেন তারা ঝেড়ে কাশতে রাজি নয়, তার কোনও ব্যাখ্যা নেই।

খটকা জাগিয়েছে ডক্টর শি-এর হাবভাবও। গোড়ায় তিনি দাবি করেছিলেন, কোভিড ছড়াতে শুরু করার পর তাঁরা নিজেদের গবেষণাগারে সংরক্ষিত ভাইরাসের তালিকা মিলিয়ে দেখেন এবং তখনই গঠনে মিল থাকা একটি ভাইরাস খুঁজে পান যার নাম আরএটিজি-১৩। কিন্তু সম্প্রতি জানা গেছে, ওই ভাইরাসটি ‘খুঁজে পাওয়া’র কোনও প্রশ্নই ছিল না। বছর চারেক আগে থেকে ওই ভাইরাস নিয়েই কাজ করছিলেন শি এবং তাঁর দলবল। যদিও তাকে অন্য নামে চিহ্নিত করা হয়েছিল। এই প্রশ্ন স্বাভাবিক ভাবেই উঠছে যে, নিজের কাজ সম্পর্কে সত্যগোপন করার দরকার কেন হল শি-র?

এর সঙ্গে যোগ হয়েছে চমকে দেওয়ার মতো দুটো তথ্য। এক, গবেষণার কাজে ওই নির্দিষ্ট ভাইরাসটিই বেছে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেহাত কাকতলীয় ছিল না। কিছু খনিশ্রমিকের মধ্যে ভাইরাল নিউমোনিয়া ছড়িয়ে পড়ার ঘটনায় ওই ভাইরাসের ক্ষমতা সম্পর্কে আগেই ধারণা করা গিয়েছিল। আর দুই, কাইমেরা ভাইরাস, অর্থাৎ কৃত্রিম ভাবে এর মাথার সঙ্গে ওর ধড় জুড়ে দিয়ে তৈরি করা বকচ্ছপ মার্কা ভাইরাস তৈরিতে শি নিজে প্রশিক্ষণ নিয়ে এসেছিলেন আমেরিকা থেকে।

এই বিষয়গুলো জানার পর নতুন করে উঠে আসছে অনেক প্রশ্ন। প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে যে বিবর্তন হতে চার দশক লাগার কথা, প্রশিক্ষিত ও অভিজ্ঞ বিজ্ঞানীদের তত্ত্বাবধানে গবেষণাগারের ভিতরে কি তা চার বছরেই ঘটে যাওয়া সম্ভব নয়? শি নিজে না হলেও তাঁর দলের বা তাঁর কাছে প্রশিক্ষণ পাওয়া অন্য কেউ কি ভাইরাসটির উপর গোপনে পরীক্ষানিরীক্ষা চালাতে পারেন না? হয়তো এমন কেউ যাঁর উপর শি-এর কোনও প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ ছিল না? আর চুপিসাড়ে যদি কেউ এমন পরীক্ষানিরীক্ষা চালান, সেই গবেষণাগারে বিপজ্জনক ভাইরাস নিয়ে কাজ করার মতো উচ্চমানের সুরক্ষা পরিকাঠামো না থাকাই স্বাভাবিক। ফলে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকিও থাকবে প্রবল। তা হলে কি সে ভাবেই ছড়িয়েছে সার্স কোভ-টু?

সম্ভাবনা আরও উস্কে দিচ্ছে বিকল্প তত্ত্বটির সমর্থনে এত দিনেও নির্দিষ্ট কোনও প্রমাণ না মেলা। ঠিক কোন প্রাণীর থেকে কখন, কী ভাবে করোনা ভাইরাস মানুষের দেহে ছড়াল, তার কোনো হদিস পাওয়া যায়নি এখনও। অর্থাৎ, সেই ২০২০ সালের গোড়ায় উহানের পশুপাখির বাজার থেকে সংগ্রহ করা নমুনা পরীক্ষার পর থেকে ‘স্পিলওভার’ তত্ত্বের সমর্থনে নতুন কোনো তথ্য বা প্রমাণ গত এক বছরে উঠে আসেনি। বরং যেটাকে আজগুবি জল্পনা মনে হয়েছিল, সেই ‘ল্যাব লিক’-এর দিকেই ইঙ্গিত করছে কিছু ঘটনা।

হাতে রইল জল্পনা

কোভিড ১৯-এর উৎস নিয়ে আদতে আমরা এখনও বিশেষ কিছুই জানি না। যে সব ব্যাখ্যা উঠে আসছে, তার কোনোটাই সন্তোষজনক নয়। কারণ, তার সিংহভাগ অনুমান আর জল্পনা।
এ বিষয়ে সকলেই একমত যে, এর মধ্যে কোনও সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র নেই। অর্থাৎ, জৈব অস্ত্র বানানোর পরিকল্পনা বুমেরাং হয়ে কোভিডের জন্ম দেয়নি। কিন্তু এই ভাইরাসের জন্ম গবেষণাগারে হয়ে থাকতেই পারে। ভাইরাসের শক্তি সম্পর্কে ধারণা করা এবং তার সম্ভাব্য প্রতিষেধক তৈরির চেষ্টায় নানা ধরনের পরীক্ষানিরীক্ষা হয়ে থাকে। অসাবধানতা অথবা দুর্ঘটনাবশত সেখান থেকেই ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়েছে, এটা এখন আর সম্ভাব্যতার গণ্ডির বাইরে নয়।

হয়তো এ রহস্যের সমাধান আদৌ কোনওদিন হবে না। তবু বিজ্ঞানীরা মনে করেন, উৎস খুঁজে পাওয়াটা জরুরি―কাউকে দায়ী করা, বা দোষারোপের জন্য নয়―টিকার কার্যকারিতা বাড়ানো জন্য এবং ভবিষ্যতে এমন অঘটন ঠেকানোর জন্য।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -

Most Popular

Recent Comments

রোশনী মুখোপাধ্যায় on ফেয়ার অ্যান্ড লাভলির দেশ
অভিষেক মল্লিক on এবার দ্যাখ কেমন লাগে
Anupam Bhattacharyya on ব্রাজিল! (২)
অভিষেক মল্লিক on ওরে বাবা ব্রাজিল!
Partha Chakraborty on নীল সামুরাই
Manju Bhattacharjee on আমার জম্মোদিন
শুভাশীষ কবীর আইচ। on আমার জম্মোদিন
নবনীতা বসু হক on আমার জম্মোদিন
নীলার্ণব চক্রবর্তী on আমার জম্মোদিন
রোশনী মুখোপাধ্যায় on আমার জম্মোদিন
শুভাশিস ঘোষ on এ সত‍্য সকলি সত‍্য
শুভ্রেন্দু রায় on মহারাজ একী সাজ হে
কৌশিক শীট। on মহারাজ একী সাজ হে
মিহির গাংগুলী on মহারাজ একী সাজ হে
তাপস কুমার পাল on মহারাজ একী সাজ হে
অপূর্ব গঙ্গোপাধ্যায় on মহারাজ একী সাজ হে
শুভাশীষ কবীর আইচ। on মহারাজ একী সাজ হে
কল্যাণ সেনগুপ্ত on আহত পুতিন আরও বিপজ্জনক
অপূর্ব গঙ্গোপাধ্যায় on কী খাবে জানি, কী খাওয়া উচিত জানিনা
অপূর্ব গঙ্গোপাধ্যায় on রাণী গেলেন, অতঃকিম?
siddhartha ghosh on বসন্ত বিলাপ
Sanghamitra Roychowdhury on হাদি থেকে জেহাদি