Sunday, September 8, 2024
Home Columns এ সত‍্য সকলি সত‍্য

এ সত‍্য সকলি সত‍্য

সাবিনা ইয়াসমিন রিঙ্কু

দীর্ঘদিন নামকরা বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়িয়েছি। অফিস পলিটিক্স আর লবিবাজিতে প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়েছে। একটা সময়ে মনে হয়েছে ধুস! চাকরির নিকুচি করেছে। কারও চোখ রাঙানি সহ্য করা বা নানা প্যাঁচপয়জার সামলানোর জন্য আমার জন্ম হয়নি। ভালোবাসা দেওয়া নেওয়া এবং এই পৃথিবীর রূপ রস গন্ধ… সবটুক নিংড়ে নেওয়া ছাড়া আর কোনও কাজ নেই আমার। তবে এটাও বুঝেছি নিজের একটা স্বাধীন ইনকাম থাকা জরুরি। চাকরি ছেড়ে দিয়ে বেশ কিছুদিন “হাতখালি” “হাতখালি” খারাপ লাগা ছিল। সেই খারাপ লাগা ভালো লাগাতে পরিণত হতে খুব বেশি সময় লাগেনি। ভাগচাষি মইদুল, মানিক, তাহের, দিলশাদ.. এরা আমার জমির সঙ্গে ওদের নিজেদের পরিশ্রমকে জুড়ে দেওয়ার পর দেখলাম লক্ষ্মীর ভাণ্ডার উপচে উঠছে। ওদের সঙ্গে মেলামেশা করার পর দেখলাম ওদেরও একজন আছেন, যাঁকে ওরা বস্ বলে মানে। দেখলাম ওদের সবার বস্ এক জনই। বেশি বৃষ্টি হলে সেই বসের কাছে কাকুতি মিনতি করে বলে, বৃষ্টি কমিয়ে দাও। কম বৃষ্টি হলে হাত তুলে বলে, মেঘ দাও, পানি দাও। তুফানে জমির ফসল লন্ডভন্ড হয়ে গেলে সেই তছনছ হয়ে যাওয়া ফসলের সামনে গিয়ে বসের উদ্দেশ্যে বলে একটু রহম কর বস্। এ বার তো খেতে না পেয়ে মরব। শুধু আমরাই মরবো না। দরিদ্র, মধ্যবিত্তরাও চারগুণ দাম দিয়ে শাক-সবজি চাল, গম কিনে নিঃস্ব হবে। বুঝলাম তাদের বস্ মানুষরূপী বসের মতো অত নিষ্ঠুর নন। তাই কিছুদিন পর তাঁর দয়ায় তছনছ হয়ে যাওয়া ক্ষেত আবার সবুজে ভরে ওঠে। দেখা যায় তুফান আসার আগে যে সবজি ফলেছিল, তুফানে বিধ্বস্ত জমি তুফান চলে যাওয়ার পর আরও বেশি ফসল ফলায়। সেই অমোঘ বাক্য আবার সত্য হয়ে সামনে দাঁড়ায়… মানুষে দিলে কুলোয় না/ ঈশ্বর দিলে ফুরোয় না।

আমার খালি হাত ঈশ্বরের দানে পূর্ণ হয়ে উঠল।

মশার কামড়, আত্মীয় স্বজনের কথার কামড়, নানা অসুখ বিসুখ মৃত্যুভয় এসব ঝামেলার জিনিস থাকা সত্ত্বেও আমি এক অর্থে স্বাধীন হলাম। এ যে কী আরাম!
ঘণ্টার পর ঘণ্টা ইছামতি নদীতে পা ডুবিয়ে বসে থাকার আর কোনও বাধা রইল না। পড়ে থাকা শুকনো পাতার ওপর দিয়ে সাপ চলে গেলে যে আওয়াজ ওঠে, কাঠবেড়ালি চলার সময় সেই আওয়াজ হয় না… এই জ্ঞান হাতে কলমে অর্জন করলাম। দেখলাম নদীর জলে পা ডুবিয়ে বসে থাকলে চেলা বা তেলাপিয়া নির্ভয়ে পায়ে সুড়সুড়ি দিয়ে চলে যাচ্ছে। পাকা ডুমুর বোঁটা থেকে খসে পড়া মাত্র এত্ত বড় গেছো ইঁদুর মুখে করে ছুট লাগাচ্ছে। বুলবুলি আর হাঁড়িচাঁচার মুখ হাঁড়ি হয়ে যাচ্ছে।
পশু পাখির খাদ্য পাকা ডুমুর হোক বা মানুষের খাদ্য ডাল ভাত… এটাই সবচেয়ে জরুরি। আর সেই সবচেয়ে জরুরি জিনিসগুলো পাওয়ার সামনে যারা বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় তারাই শত্রু। তাই বলে ইঁদুর কিন্তু পাখির শত্রু নয়। তার ছোট্ট পেট ভরে গেলে বাকি ডুমুরগুলো পাখিদের জন্য পড়ে থাকে।

তেঁতুলগাছের তলায় দাঁড়িয়ে থাকি। সবুজ ঝিরিঝিরি পাতার হাওয়া খাই। তেঁতুলের ফুলের কথা কেউ বলে না বলে ভারী অবাক লাগে। এমন সুন্দর ফুল খুব কমই দেখেছি! ছোট্ট ফুলের ভিতরে কতই না কারুকাজ! আমি পথ হেঁটে চলা লোকদের ডেকে ডেকে দেখাই। অনেকের ফুল দেখতে বয়েই যায়! আবার কত জন যে আসে! আমার মতই মুগ্ধ হয়। ন’জন সুজন একসঙ্গে হলেই গাছের তলায় ঘাসের ওপর বসে পড়ি। মোটা কালো পিঁপড়েরা অসন্তুষ্ট হয়ে অন্য পথ ধরে। সেটাও আমার চোখ এড়ায় না। কর্মহীন হয়ে আর আলসেমি করেই গোটা দিনটা কাটে তা কিন্তু নয়। সংসারে যেটুকু আমার দায়িত্ব, সেটুকু গুছিয়ে করি। সেখানে ফাঁকি দেওয়ার অভ্যেস নেই। তবে তার বাইরে আর কিছু করি না। গবেষণা, কোনও বিষয়ে থিসিস লেখা আমার কর্ম নয়। ও আমার বিদ্যায় কুলোবে না। নিজে সিরিয়াস লেখা লেখার চাইতে অন্যের ভালো সাহিত্য সৃষ্টির অনুপ্রেরণা হতে বেশি ভালো লাগে।

মানব জন্ম পেয়েছি। এই প্রকৃতির সব রূপ রস শুষে নেয়ার চেষ্টা করব এই জন্মেই। ঘণ্টার পর ঘণ্টা নদীর পাড়ে বসে জলের গান শুনব। মেঘের খামখেয়ালিপনা দেখে রাগ করব। বিস্মিত হব। নিজের চোখে সূর্য ডোবা দেখে ঘরে ফিরে এসে অপেক্ষায় থাকব নতুন ভোরের।

পৃথিবীতে এসে দাগ রেখে যাওয়া খুব কঠিন। অনেক পরিশ্রম, অনেক সাধনার ব্যাপার। ও পথে হাঁটা মানুষগুলো অন্য। আলাদা মাপের। তাঁদের শ্রদ্ধা ভক্তি করব। কিন্তু ও পথ মাড়াবার চেষ্টা করব না। ঈশ্বরের সব সুন্দর সৃষ্টিকে মন প্রাণ দিয়ে আস্বাদন করব। কে করলেন, কেন হল, কী ভাবে হল… এসব সংশয়ে থাকব না। এক জন্মে কত জায়গা দেখা হল না, কত অপরূপ দৃশ্যের সাক্ষী হওয়া হল না বলে হেদিয়ে না মরে যেগুলো চোখের সামনে বা আয়ত্তাধীন, সেগুলোই মন দিয়ে দেখব। পথের গল্প ভাগ করে নেব সবার সঙ্গে । তবে রোজ নয়। আমার যেদিন ইচ্ছে হবে, কেবল সেদিনই।
পাকা ধানের গন্ধ পৌঁছে দেব সবার অন্দরমহলে।
কচি ডাবের তরকারি রেঁধে খাওয়াব। কোনও কারণে ফেসবুক নামক প্ল‍্যাটফর্মটা বন্ধ হয়ে গেলেও আমাদের গল্প বন্ধ হবে না। ময়দানে গল্পের আসর বসবে। কাজ থেকে বাড়ি ফেরার পথে ওই দিকে একটিবার ঢুঁ মারলেই দেখবেন প্রচুর গল্প ঘাসের গালিচায় বিছানো রয়েছে। যে কোনও একটা তুলে নিলেই ভাঁড় ভর্তি দুধ চা আর বক ফুলের বড়া ফাউ।

RELATED ARTICLES

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -

Most Popular

Recent Comments

রোশনী মুখোপাধ্যায় on ফেয়ার অ্যান্ড লাভলির দেশ
অভিষেক মল্লিক on এবার দ্যাখ কেমন লাগে
Anupam Bhattacharyya on ব্রাজিল! (২)
অভিষেক মল্লিক on ওরে বাবা ব্রাজিল!
Partha Chakraborty on নীল সামুরাই
Manju Bhattacharjee on আমার জম্মোদিন
শুভাশীষ কবীর আইচ। on আমার জম্মোদিন
নবনীতা বসু হক on আমার জম্মোদিন
নীলার্ণব চক্রবর্তী on আমার জম্মোদিন
রোশনী মুখোপাধ্যায় on আমার জম্মোদিন
শুভাশিস ঘোষ on এ সত‍্য সকলি সত‍্য
শুভ্রেন্দু রায় on মহারাজ একী সাজ হে
কৌশিক শীট। on মহারাজ একী সাজ হে
মিহির গাংগুলী on মহারাজ একী সাজ হে
তাপস কুমার পাল on মহারাজ একী সাজ হে
অপূর্ব গঙ্গোপাধ্যায় on মহারাজ একী সাজ হে
শুভাশীষ কবীর আইচ। on মহারাজ একী সাজ হে
কল্যাণ সেনগুপ্ত on আহত পুতিন আরও বিপজ্জনক
অপূর্ব গঙ্গোপাধ্যায় on কী খাবে জানি, কী খাওয়া উচিত জানিনা
অপূর্ব গঙ্গোপাধ্যায় on রাণী গেলেন, অতঃকিম?
siddhartha ghosh on বসন্ত বিলাপ
Sanghamitra Roychowdhury on হাদি থেকে জেহাদি